পুরস্কার ঘোষণার পর প্রাণহানী দ্বিগুণ!

২০ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ২৬ জানুয়ারি ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ২৪ জানুয়ারি র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ২১ জানুয়ারি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এবং সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ঘোষণা দিলেন, ‘বোমাবাহজ ও নাশকতাকারীদের ধরিয়ে দিলে লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেয়া হবে।’

সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের মুখ থেকে পুরস্কারের ঘোষণা এলেও থামেনি নাশকতা। বোমাবাজরা প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ট্রাক বা বাসে অথবা ট্রেনে পেট্রোল বোমা হামলা চালাচ্ছে। দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমায় পুড়ছে নিরীহ মানুষ। দ্গ্ধ মানুষদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন ইউনিট। এই অবস্থায় পুরস্কার ঘোষণা নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ৫ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার বলি হয়েছেন ২৭ জন। ২১ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫ দিনে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫২ জন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, পুরস্কার ঘোষণার পর সহিংসতার বলি হয়েছেন দ্বিগুণ মানুষ। অথচ পুরস্কার ঘোষণার পর স্বাভাবিকভাবেই সহিংসতা কমার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে উল্টো।

২০ জানুয়ারি হরতাল-অবরোধে নাশকতাকারীদের ধরতে সর্বপ্রথম পুরস্কার ঘোষণা করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সেদিন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত কমিটির সদস্যরা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ ঘোষণা দেন।

পরদিন ২১ জানুয়ারি পুরস্কার ঘোষণা করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে তিনি পুরস্কারের এ ঘোষণা দেন।

এই দুই মন্ত্রীর পুরস্কার ঘোষণার পরেরদিনই অর্থাৎ ২৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এতে বাসে থাকা অন্তত ২৯ যাত্রী দগ্ধ হন। ঘটনায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে নূরে আলম নামের এক ঠিকাদার মারা যান। দগ্ধরা এখনো ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

২৪ জানুয়ারি শনিবার, নাশকতাকারীদের ধরিয়ে দিলে মোট ৮টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দেন র‌্যাব মহাপরিচালক। এমনকি গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ, বোমা, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ছবি ব্যক্তিগত মোবাইল বা ক্যামেরায় ভিডিও চিত্র ধারণ করে র‌্যাবকে দিলেও ১০ হাজার টাকা দেয়া হবে বলে জানানো হয়। এছাড়া টিভি চ্যানেলে দেখানো বোমা, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপকারী ও যানবাহন ভাঙচুরকারীদের গ্রেপ্তারে সাহায্য করলে ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণাও দেয়া হয় র‌্যাবের পক্ষ থেকে।

এ ঘোষণার ঠিক কয়েক ঘণ্টার মাথায় ওইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় (রাজশাহী মেট্রো-ড-০৪-০০৮) একটি পার্কিং করা বাসে পেট্রোল বোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। বাসটিতে এসময় যাত্রী না থাকায় হতাহতের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তবে বাসটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

একই দিনে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুরে চাল ভর্তি একটি ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শিমুল (১৮) নামে ট্রাকের হেলপার দগ্ধ হন। তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

২৬ জানুয়ারি ৩ ক্যাটাগরিতে লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া। ঘোষণার পরদিনই ২৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের শুকলাল হাট এলাকায় একটি পেঁয়াজবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় চালকসহ দুইজন দগ্ধ হন। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

২৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে চাঁদপুর সদর উপজেলার ঘোষেরহাট এলাকায় দুর্বৃত্তদের পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান মোতালেব হোসেন (৪০) নামের এক ট্রাক হেলপার। টাইলস বোঝাই ট্রাকটি নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর যাচ্ছিল।

সর্বশেষে ১ ফেব্রুয়ারি নাশকতাকারী ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ঘোষণা করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেছিলেন, নাশকতাকারীদের হাতে-নাতে ধরিয়ে দিলে এক লাখ টাকা দেয়া হবে।’ তথ্য প্রমাণসহ নাশকতার পরিকল্পনাকারীদের ধরিয়ে দিলেও তথ্যদাতাদের পুরস্কার দেয়ার কথা বলা হয়।

এমন ঘোষণার ঠিক একদিন পর ২ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুর রেলস্টেশনে চলন্ত ট্রেনে পেট্রোলবোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে পাঁচ যাত্রী দগ্ধ হন। কমিউটার এক্সপ্রেসে ট্রেনটি ঢাকা থেকে জামালপুর যাচ্ছিল।

সরকারের মন্ত্রী, র‌্যাব ও পুলিশের বিভিন্ন ক্যাটাগরির পুরস্কারের ঘোষণাতেও থামেনি পেট্রলবোমার মতো প্রাণঘাতি বিস্ফোরকের ব্যবহার। যার প্রমাণ মিলেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের এক মাসের তথ্যে।

অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে গত ৪ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক মাসের সহিংসতায় ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা ১১২ জন। এদের মধ্যে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে, চিকিৎসা শেষে রিলিজ করা হয়েছে ৪৫ জনকে এবং ৬০ জন বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছেন।

পুরস্কার ঘোষণার পর সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘একদিনেই তো আর সব নাশকতাকারী বা বোমাবাজদের ধরা সম্ভব না। যে কোনো সঙ্কট মোকাবেলাতেই কিছুটা সময়ের দরকার হয়।’

তবে জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকের চেয়ে শেষের দিকে রাজধানীতে নাশকতার ঘটনা কমে এসেছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ডিএমপির পক্ষ থেকে ২ জনকে (মধ্যম ক্যাটাগরিতে) ককটেল, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপকালে অপরাধী গ্রেপ্তারে সহায়তা করায় পঞ্চাশ হাজার টাকা করে পুরস্কার দিয়েছি। মতিঝিল এলাকায় ককটেল নিক্ষেপকালে পৃথক ঘটনায় দুই যুবককে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।’ তবে গোপনীয়তার স্বার্থে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোলবোমা হামলা থেকে নিজেসহ তিনজনকে রক্ষায় সাহসিকতা দেখানোর জন্য হাবিবুর রহমান নামে পিকআপ চালককে পুরস্কৃত করেছে পুলিশ। ৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার সকাল ৮টায় বরিশাল আগৈলঝাড়া থানায় পুলিশ সুপার একেএম এহসান উল্লাহ ওই চালকের হাতে দশ হাজার টাকা নগদ তুলে দেন।

আগৈলঝাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ) মো. মনিরুল ইসলাম  জানান, সাতক্ষীরা থেকে বরিশালের উদ্দেশে ফল নিয়ে আসছিল পিকআপটি। পথিমধ্যে আগৈলঝাড়া বাজার সংলগ্ন বাইপাস সড়কে পৌঁছামাত্র দুর্বৃত্তরা পেট্রোলবোমা ছুঁড়ে মারে। এ সময় চালক হাবিবুর রহমান কৌশলে পিকআপটি পিছিয়ে নিলে সেখানে থাকা তিনজন দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায়। তবে পিকআপটি আগুনে পুড়ে যায়। চালক হাবিবুর রহমানের বুদ্ধিমত্তার জন্য ওই তিন ব্যক্তি বেঁচে যান।

একইভাবে র‌্যাবও দাবি করেছে, হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে নাশকতা করার সময় তিন নাশকতাকারীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পাঁচজনকে মোট এক লাখ টাকা পুরস্কার দেয়া হয়েছে।

ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ দিনে রাজধানীতে ছয় শতাধিক ককটেল ও পেট্রোলবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে দু’জন নিহত ও অন্তত ১০০ জন আহত বা দগ্ধ হয়েছেন। এ ব্যাপারে নগরীর বিভিন্ন থানায় ৪৯টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ঢাকা মহানগর এলাকা থেকে ৬৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১০৬ জনকে জনতা হাতে-নাতে ধরে পুলিশে দিয়েছে। যার মধ্যে ৬৭ জন বিএনপি ও ৩৯ জন জামায়াত সমর্থক। এদের ২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও দেয়া হয়েছে। তবে ঢাকা মেডিকেল ও নগরীর বিভিন্ন থানায় এলাকায় সূত্র মতে, ভাঙচুর ও গ্রেপ্তারের চিত্র আরো ভয়াবহ।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত ৬ জানুয়ারি সারাদেশে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন। এরপর থেকে প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ ও হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে।



মন্তব্য চালু নেই