পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চামচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিল তারা
তৈয়বুর রহমান : নিজেদের অতীত জানার চেষ্টা করছে মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকে। সব মানুষের এটি সহজাত প্রবৃত্তি হলেও জাতি ভেদে অতীত জানার আগ্রহে পার্থক্য আছে বিস্তর।
বাঙালিরা বিস্মৃতিপরায়ন জাতি হলেও পশ্চিমারা কিন্তু মোটেও তা নয়। জীবন থেকে কোনো কিছু হারিয়ে যেতে দিতে রাজি নয় তারা। এদিক দিয়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে আছে ইহুদিরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বের করছে তারা নানাভাবে, প্রয়োজনে মাটি খুড়ে। শুধু একটু আলামত পেলেই হলো। হাউন্ডের মতো যা জানতে চায়, ঠিক সেখানেই পৌঁছে যায় তারা। অতি সম্প্রতি একটি সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়েছে তারা লিথুয়ানিয়ার বনাঞ্চলে।
লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসের ঠিক বাইরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের সুড়ঙ্গটি তৈরি করে ইহুদী বন্দিরা। নাৎসিদের কবল থেকে বাঁচার জন্য এটি তৈরি করে তারা চামচ দিয়ে মাটি খুঁড়ে। এটির সন্ধান মেলে লিথুয়ানিয়ার পোনার বনাঞ্চলে। এখন অবশ্য জায়গাটির নাম পোনার নয়, বললে চিনবেও না কেউ। আধুনিককালে জায়গাটি পরিচিত প্যানেরিয়াই বনভূমি নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের লোকজন লিথুয়ানিয়া দখল করে নিয়ছিল। তারপর নাৎসি বাহিনী সেখানে চালায় নির্মম নির্যতন। তাদের বর্বরতায় মারা পড়ে আনুমানিক এক লাখ মানুষ। হত্যা করে তাদের মাটি চাপা দেয়া হয় বেশ কয়েকটি গর্তে, যা এখন গণকবর হিসেবে পরিচিত। ওই এক লাখ মানুষের মধ্যে ৭০ হাজার ইহুদী ছিল বলে ধারণা করা হয়।
সুড়ঙ্গটির কথা জানা ছিল ঐতিহাসিকদের। হত্যাকা-ের সময় প্রাণে বেঁচে যায় ১১ ব্যাক্তি, পরবর্তীতে তাদের সাক্ষ্য থেকে গণকবরের কথা জানাজানি হয়ে যায়। সেই সঙ্গে প্রকাশ হয়ে পড়ে সুড়ঙ্গটির কথা। কারা এবং কেন এই সুড়ঙ্গটি খোঁড়ার কথাও জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু ঐতিহাসিকরা গণকবরেরই সন্ধান পাচ্ছিলেন না, সুড়ঙ্গ তো দূরের কথা। কিন্তু অতিসম্প্রতি কপাল খোলে ঐতিহাসিকদের। খুঁজে পান তারা সুড়ঙ্গটির প্রবেশপথ।
এটি খুঁজে পান প্রত্নতাত্তিক, ভূপদার্থবিদ ও ঐতিহাসিকদের নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষক দল। অস্ট্রেলিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ওয়ার্লিপর্সন্সের ভূপদার্থবিদ বিভাগের পরিচালক পল ব্রাউম্যান বলছেন, সুড়ঙ্গটির কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে বালুর সঙ্গে মিশে গেছে। আর কিছু অংশ থেকে বালু বেরিয়ে এসেছে।
সুড়ঙ্গটির সন্ধান চালাতে গিয়ে গণকবরের দেহাবশেষগুলোকে কোনো রকম বিরক্ত করতে চাননি দলের সদস্যরা। এ করণেই তারা ব্যবহার করেন আধুনিক স্ক্যানিং প্রযুক্তি। খনিজ সম্পদ ও তেল অনুসন্ধানের সময় এই প্রযুক্তি বা ইলেক্ট্রক্যাল রেজিস্টিভিটি টোমোগ্রাফি ব্যবহার হয়।
ইলেক্ট্রক্যাল রেজিস্টিভিটি টোমোগ্রাফি ব্যবহার করেই ৩৪ মিটার লম্বা সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসা ও ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজে বের করা হয়।
ইসরায়েলের প্রত্নতাত্তিক কর্তৃপক্ষের প্রত্নতাত্তিক জন সেলিগম্যাম বলছেন, ‘পোনারের ওই অন্ধকার গর্ত আমাদের মধ্যে কিছুটা আশার আলো সঞ্চার করেছে। একে তিনি মানব সভ্যতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম পিবিএসের সায়েন্স সিরিজ নোভার জন্য আসন্ন প্রামান্যচিত্রের উপজীব্য হবে এই গুহা ও এর কাহিনী। প্রমান্যচিত্রে ফুটিয়ে তোলা হবে মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্খা যে কতো প্রবল হতে পারে, কতো অকল্পনীয় কাজ করতে পারে, তা তুলে ধরা হবে।
সুড়ঙ্গটি খোঁড়ার কাজে যেসব বন্দি অংশ নেন, ইতিহাসে তারা পরিচিতি পান বার্র্নিং ব্রিগেড হিসেবে। কিন্তু কেন এই পরিচিতি? এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্রাউম্যান বলছেন, ‘১৯৪৩ সালের শেষদিকে নাৎসিরা বুঝতে পারছিল তারা হেরে যাচ্ছে আর সোভিয়েতরা (বর্তমানে রাশিয়া) এগিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে নাৎসিরা তাদের অপকর্মের সব আলামত নষ্ট করে ফেলতে চাইলো। ৮০ বন্দিকে নিয়ে গঠন করলো বার্নিং ব্রিগেড।’
‘এই বার্নিং ব্রিগেডের সদস্যদের দিয়ে গর্তে ফেলা হাজার হাজার লোকের দেহাবশেষ তুলে সেগুলো পুড়ে ফেলে নাৎসিরা,’ বললেন তিনি।
ব্রাইম্যান বলছেন, নির্মম নির্যাতন সত্ত্বেও নাৎসিদের কর্মকা- বিনা বাঁধায় মেনে নেয়নি তারা। গড়ে তোলে প্রবল প্রতিরোধ।
‘নির্মম ও ভয়ঙ্কর এই কাজ করার সময় অন্তত দু’জন ব্যবহৃত অলংকার ও কাপড় দেখে চিনতে পারেন তাদের পরিবারের সদস্যদের। একজন চিনতে পারেন তার ছেলেকে এবং অপরজন চিনতে পারেন তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে,’ বললেন তিনি।
এরপর পালানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা পেয়ে বসলো তাদের। হাতের কাছে পেলো চামচ। তাই দিয়ে এবং হাত ব্যবহার করে খুঁড়তে লাগলো তারা সুড়ঙ্গ। এ কাজে সময় লাগে তাদের ৭৬ দিন। ভাগ্যে কি আছে তারা তা জানে না। এমন কি, গুলি খেয়ে মরার ভয়ডর পযন্ত উবে গেছে তাদের। সামনে কী অপেক্ষা করছে তারা তাও জানে না।
‘অবশেষে পালানোর সময় ঘনিয়ে আসলো। ১৯৪৪ সালের ১৫ এপ্রিল। আকাশে চাঁদ নেই, ঘুটঘুটে অন্ধাকার। সুড়ঙ্গ পথে বেরিয়ে পড়লো তারা একে একে,’ বললেন ব্রাউম্যান।
‘এমন সময় রক্ষীরাও টের পেয়ে গেল যে, কেউ পালিয়ে যাচ্ছে বন্দি শিবির থেকে। তারা গুলি চালানো শুরু করলো। গুলিতেও থামাতে না পেরে শুরু করলো মর্টার দিয়ে গোলা বর্ষণ,’ বললেন তিনি।
ব্রাউম্যান বলেন, কিন্তু পলাতক বন্দিদের সামনে ছিল আরও কঠিন বাধা। প্রথম কাটা তারের বেড়া কাটার পর তারা দেখলো আরেকটি কাটা তারের বেড়া। তারপরে আবার মাইনফিল্ড। এখানেই শেষ নয়, এতো সব বাধা পেরিয়ে ফের পাঁচ মাইল হাঁটার পর দেখা মেলে নদীর। এই পাঁচ মাইল পাহারা দিচ্ছিল জার্মান হাউন্ড।
এতো সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পালাতে পারে মাত্র ১২ জান। আর যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে মাত্র ১১ জন। তারাই তাদের সাক্ষ্যতে তাদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সূত্র: রাইজিংবিডি
মন্তব্য চালু নেই