পাগল হতে চেয়ে ব্যর্থ লতিফ সিদ্দিকী
আমেরিকায় বসে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার পর নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে প্রাক্তন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী নিউ ইয়র্কের এলমাস্ট হাসপাতালে যান নিজেকে মানসিক ভারসাম্যহীন (মেন্টাল ডিজঅর্ডার) হিসেবে সনদ নেওয়ার জন্য। কিন্তু চিকিৎসকরা প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ ধরনের সার্টিফিকেট দিতে রাজি হননি।
এলমাস্ট হাসপাতালে কর্তব্যরত এক বাঙালি চিকিৎসক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে রাইজিংবিডিকে জানান, লতিফ সিদ্দিকী আমেরিকা ত্যাগের আগে ওই হাসপাতালে যান এবং নিজেকে অসুস্থ ও মানসিক ভারসাম্যহীন দাবি করে চিকিৎসাসেবা নিতে চান। চিকিৎসকেরা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ ধরনের কোনো আলামত পাননি। যে কারণে ‘মেন্টাল ডিজঅর্ডার’ সনদ দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে ওই চিকিৎসক জানান।
এদিকে কলকাতায় অবস্থানকারী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী তাজ হোটেল থেকে বেরিয়ে মঙ্গলবার দুপুর থেকে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে তিনি কোথায় গেছেন, কেউ তা জানেন না।
কলকাতা প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার বিকেল থেকে লতিফ সিদ্দিকীর ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র আভাস দিয়েছেন, দেশে ফিরলে গ্রেফতারের ভয় এবং গণমাধ্যমে কথা বলে নতুন বিতর্কে জড়াতে চান না বলেই তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।
জানা গেছে, ভারতে নেমেই তিনি দেশটির সরকারের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। বর্তমানে লতিফ সিদ্দিকীর আচরণ রহস্যজনক বলে মনে করছেন তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র। কলকাতায় বিমানবন্দরে তাকে রিসিভ করেন তার ছেলে বাংলাদেশের মরিয়ম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলম। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
আত্মগোপনের আগে লতিফ সিদ্দিকী বিবিসিকে বলেন, তিনি দেশে ফিরতে চান। তবে এ ব্যাপারে দল ও সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন তিনি। দেশে ফিরলে দল ও সরকারকে আরো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা হবে কি না, তা নিয়েও তিনি চিন্তিত।
দলীয় সূত্রমতে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী দেশে ফিরলে তার উপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে- এমন আশঙ্কায় কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না ক্ষমতাসীনরা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের এমন মনোভাবের বিষয়টি তার পরিবারকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সবুজ সংকেত না দেওয়া পর্যন্ত তাকে দেশের বাইরেই থাকতে হবে।
একই সঙ্গে তিনি যাতে দেশে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য বিমানবন্দর ও সীমান্তের সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে সরকারের উপর মহলের প্রয়োজনীয় মৌখিক নির্দেশনা। ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে কটূক্তিসহ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার কারণে প্রেসিডিয়াম পদ থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর কেন স্থায়ীভাবে তার প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হবে না, এর কারণ জানতে চেয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে আওয়ামী লীগ। রাজধানীর জিগাতলা পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে লতিফ সিদ্দিকীর টাঙ্গাইলের কালিহাতীর স্থায়ী ঠিকানায় ওই নোটিশ পাঠানো হয়। বুধবার নোটিশটি ওই ঠিকানায় পৌঁছেছে বলে তার পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘আপনি (লতিফ সিদ্দিকী) সংগঠনের গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকায় গত ১২ তারিখ গণভবনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আপনার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও গর্হিত বক্তব্য শুধু অনভিপ্রেতই নয়, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণসহ বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের মনে চরম আঘাত করেছে। এটা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের লালিত নীতি, দলের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থী। যেহেতু আপনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে দলের বিকশিত লক্ষ্য-আদর্শবিরোধী কাজ করেছেন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন বক্তব্য দিয়েছেন, এতে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ শুধু নিন্দাই জানায়নি, গঠনতন্ত্রের ৪৬ ধারার ‘ক’ ও ‘ঞ’ উপধারা লঙ্ঘন করায় আপনাকে প্রেসিডিয়াম পদ থেকে বহিষ্কার করেছে। সেই সঙ্গে আপনার প্রাথমিক সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত করা হয়। কেন স্থায়ীভাবে প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে আপনাকে বহিষ্কার করা হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে নিম্নস্বাক্ষরকারীর (সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদকে জানাতে বলা হলো।’
দেশে ফিরলে সিদ্ধান্ত : বিদেশ সফর শেষে দেশের ফেরার পর লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ থাকা-না থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ। মন্ত্রিত্ব হারানো ও দলীয় সদস্যপদ স্থগিত হওয়ার পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার। তবে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ আপাতত থাকছে। সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিদ্যমান যে বিধান আছে, তা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ তিনি দলের বিরুদ্ধে ভোট দেননি বা পদত্যাগও করেননি। এমনকি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদেও কিছু করেননি। যে কারণে তার বিষয়টি ফ্লোর ক্রসিংয়ের আওতায়ও পড়ে না।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আ স ম ফিরোজ এসব কথা জানান। লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে মন্ত্রীদের নানা ব্যাখ্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিফ হুইপ বলেন, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে সংবিধান বা সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। তাই এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে তা অবসানে স্পিকার সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রয়োজনে আইনজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন তিনি।
আরো দুটি মামলা : কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, হজ ও তাবলিগ জামাতকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় প্রাক্তন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জ আদালতে দুটি মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জ ৪ নম্বর আমলি আদালতে মামলাটি করেন অষ্টগ্রাম উপজেলার কাগজী গ্রামের মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ। বিচারক ফজলে রাব্বী মামলাটি আমলে নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে সোমবার কিশোরগঞ্জ বারের আইনজীবী কামরুল ইসলাম রতন বাদী হয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অনুরূপ একটি মামলা করেন।
মন্তব্য চালু নেই