পাকিস্তান দিবস ও লাহোর প্রস্তাব

মহা ধুমধামে উদযাপিত হচ্ছে পাকিস্তান দিবস। সাত বছর বিরতি দিয়ে এবার এই জাতীয় দিবস উদযাপন করছে পাকিস্তান।

৭৫ বছর আগের এই দিনে (২৩ মার্চ, ১৯৪০) লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা স্মরণীয় করে রাখতে দিবসটি উদযাপন করে পাকিস্তানীরা।

পাকিস্তান দিবসের ঐতিহাসিক বিবর্তন চোখে পড়ার মতো। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাবের দিনটি প্রথমে পাকিস্তান দিবস ছিল না। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংবিধান চূড়ান্ত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্র। এই দিনকে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস অর্থাৎ পাকিস্তান দিবস হিসেবে উদযাপন করা হতো।

কিন্তু স্বৈরশাসক আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করায় সংবিধান স্থগিত হয়। ফলে পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস ঐতিহাসিক গুরুত্ব হারায়। কিন্তু পাকিস্তান দিবস উদযাপন থেমে থাকেনি। তিনি টেনে আনেন ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের দিনটিকে। রাজনৈতিক ঘূর্ণিতে পড়ে পাল্টে যায় পাকিস্তান দিবসের তাৎপর্য।

লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গে পাকিস্তান দিবসের যৌক্তিক সম্পর্ক কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। ১৯৪০ সালের ২২ থেকে ২৪ মার্চ, এই তিন দিন সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় লাহোরে। সম্মেলনের আগের সমঝোতার সূত্র ধরে উত্থাপিত হয় লাহোর প্রস্তাব। অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপন করেন লাহোর প্রস্তাব।

এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ভারতীয় মুসলিমদের জন্য দুটি স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম প্রাদেশিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। এই রাষ্ট্রের অধীনে মুসলিমরা তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐহিত্যগত অধিকার চর্চার স্বাধীন সুযোগ ভোগ করবে।

লাহোর প্রস্তাবের আগেই সে সময়ের প্রভাবশালী কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবাল মুসলিমদের জন্য অখ- রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। সেই দাবির সঙ্গে লাহোর প্রস্তাবের পুরোপুরি সঙ্গতি ছিল না। কিন্তু সর্ব ভারতীয় মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ লাহোর সম্মেলনে তার বক্তব্যে দ্বিজাতি তত্ত্ব তুলে ধরেন। যেখানে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌমত্ব গুরুত্ব পায়।

পরে আল্লামা ইকবালের সেই অভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের দাবি জোরালো হয় পাকিস্তানি নেতাদের কারণেই। প্রবল রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে এবং নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় অখ- পাকিস্তানের। পূর্ববঙ্গ হয় পাকিস্তানের প্রদেশ। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের ঐতিহাসিক দাবি পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িতক চেতনার দেশ। ভারতও তাই। কিন্তু পাকিস্তান সেই দ্বিজাতি তত্ত্বকে আজো স্মরণ করে যাচ্ছে মহাধুমধামের মধ্য দিয়ে। এই দ্বিজাতি তত্ত্বের সৃষ্টি পাকিস্তানের কাছে থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আশা করা সম্ভব কি?

লাহোর প্রস্তাবের ৭৫ বছর পরেও আমরা যা দেখছি, তা পাকিস্তানকে অসাম্প্রদায়িক আধুনিক রাষ্ট্রের কাতারে ফেলে না। ধর্মের নামে দেশটিতে রক্তপাত চলছে। মসজিদ, মন্দির, গির্জায় আত্মঘাতী হামলা হচ্ছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে দিন দুপুরে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে ভিন্ন ধর্মের মানুষদের।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কেন সেই লাহোর প্রস্তাবকে টেনে ঐতিহাসিক মূল্য দেওয়ার চেষ্টার করছে পাকিস্তান? প্রগতিশীল ও আধুনিক পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের জন্য ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চকে আমার দৃষ্টিতে সামনে আনা উচিত। গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চা এতে করে বাড়বে। কিন্তু বছরে বছরে দ্বিজাতি তত্ত্ব সামনে এলে ধর্মীয় সংঘাত ও উন্মাদনা আরো বাড়বে।

শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে পাকিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ। আজ যেখানে চলছে ধর্মীয় উন্মাদনা। এ মোটেও কাম্য হতে পারে না। যদি তারা ঐতিহাসিক ভুল থেকে শিক্ষা নেয় তাহলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পাকিস্তান।



মন্তব্য চালু নেই