পাকিস্তানের এই প্রত্যন্ত গ্রাম সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই আপনার
বেশ উত্তেজিত সাজিদ আলভি। সুইডেনে পড়ালেখার সুযোগ মিলে গেছে তার। জানালেন, আমি পিএইচডি করতে চাই। টার্বো ইঞ্জিনের ফ্রিকশন আমার বিষয়। অ্যারোস্পেসের যন্ত্রপাতির উন্নয়নে কাজ করবো আমি।
পাকিস্তানের এক পাহাড়ি গ্রামে থাকেন তিনি। আত্মীয়-স্বজনরা নতুন দেশে পাঠাতে তাকে বিদায় জানাতে এক হয়েছেন। দেশ থেকে ৩ হাজার মাইল দূরে চলে যাচ্ছেন তিনি। একজন বললেন, আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে। আলভির বাড়ির সামনের আলুর ক্ষেত্রে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আরেকজন বললেন, তোমার এই বড় বড় দাড়ি আর রাখতে পারবে না। তোমাকে তালেবানের মতোই দেখাচ্ছে।
একটা ছোট প্যান্ট আর ইয়ানকিসের ক্যাপ পরেছেন আলভি। পারসিয়ানদের এক গোত্র ওয়াখির সদস্য তিনি। এই পোশাক তার ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই নয়। এখানে উপস্থিত অন্যান্যদের মতো তিনি ইসমাইলি। ইসলামের একটি মধ্যপন্থী শাখা যার ইমাম আগা খান। বর্তমানে তাদের ইমাম থাকেন ফ্রান্সে। বিশ্বে ইসমাইলির সংখ্যা ১৫ মিলিয়নের মতো। পাকিস্তানের উত্তরাংশের গোজাল অঞ্চলে থাকেন ২০ হাজারের মতো।
কারাকোরাম রেঞ্জে ঘেরা এই অঞ্চল। বহুকাল ধরে ইসমাইলিরা থাকেন এখানে। কিন্তু সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। পর্যটকরা খুব কমই আসেন। অবশ্য একটি হাইওয়ে হয়েছে। মোবাইল ফোনও এসেছে। তাদের মাঝে আধুনিক জীবনযাপনের সংস্কৃতি প্রবেশ করছে। ফ্যাশনে এসেছে পরিবর্তন। প্রযুক্তি গ্রহণ করেছেন তারা।
এই অঞ্চল নিয়ে নিবন্ধটি লিখেছেন ম্যাথিউ প্যালে। বলছেন, ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে আমি এবং আমার প্রেমিকা পাকিস্তানে বেড়াতে আসি। কারাকোরাম রেঞ্জের পথ বেয়ে ঘোরার ইচ্ছা ছিল। এই রেঞ্জে রয়েছ সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ যার উচ্চতা ৮০০০ মিটারেরও বেশি। বছরে পাকিস্তানের উত্তরাংশে এক লাখ পর্যটক বেড়াতে আসেন। আমরা এখানে মাসের পর মাস থেকেছি। ভাষা শিখেছি। কারাকোরাম, হিন্দুকুশ এবং পামিরে অভিযান চালিয়েছি। এখানে বিগত ১৭ বছর ধরে আসছি আমি। কিন্তু নয় এগারোর পর এখানে আসা অনেক কঠিন হয়ে গেছে। কেউ আর আসতেও চান না। এমনটাই বললেন স্থানীয় ট্যুর গাইড করিম জান। প্রতিবারের ভ্রমণে এখানে পরিবর্তন চোখে পড়ে। হাইওয়ে হয়েছে। এই রাস্তায় জিপ ছাড়াও বড় যান চলতে সক্ষম। পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষরাও বেড়াতে আসতে শুরু করেছেন।
তরুণ-তরুণিরা বিভিন্ন শহরে পড়াশোনা করতে গেছেন। ছুটিতে তারা আধুনিক ফ্যাশনে সজ্জিত হয়ে বাড়িতে আসেন। দোকান হয়েছে যেখানে নতুন স্বাদের আধুনিক খাবার বিক্রি হয়। তবে উৎসবে ঐতিহ্যবাহী খাবারও বিক্রি হয়। পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি এখানে ঢুঁ মারছে। তবে এগুলো ওপরের স্তরের পরিবর্তন। গোজালের সেই আদিম আত্মা তেমনটাই রয়েছে।
করিম বলেন, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের সম্পর্ক এবং আতিথেয়তা কখনো বদলায়নি এবং বদলাবেও না। আমাদের ছেলে-মেয়েরা বড় বড় শহরে পড়তে যায়। কিন্তু তারা পাহাড়ি কৃষকের ছেলে-মেয়েই রয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই আমরা দুঃখ করি। বাইরের বিশ্ব আমাদের সম্পর্কে যে ধারণা পোষন করে তা জেনে। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে আমরা যতটা না দুঃখ প্রকাশ করি, তার চেয়ে বেশি ঠাট্টা-তামাশা করি। তাদের ধারণা এতটাই ভুল।
ম্যাথিউ লিখেছেন, যেদিন আলভি বিদায় নেন, সেদিন আমরা কাছের একটি পাহাড়ে উঠলাম। সেখানে কম বয়সীরা এক হয়ে সময় কাটাচ্ছেন। দূরে দেখা যাচ্ছে তুপোপদানের চূড়া। কয়েকজনের পরনে আধুনিক হিল স্পোর্ট ডিজাইনার টি-শার্ট ও জিন্স। তাদের দাড়ি স্টাইল করে কাটা এবং অনেকের রয়েছে পনি টেইল। অনেকে ঐতিহ্যবাহী সাদা প্যান্ট এবং লম্বা শার্ট পরেছেন। সেখানে বড় আকারের স্পিকার এনে আধুনিক ড্যান্সবল এবং ঐতিহ্যগত গান বাজানো হচ্ছে। এদের সবাই স্কুলে যান। অধিকাংশই অন্তত চারটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। ইংরেজি, ওয়াখি এবং উর্দুতে কথা বলতে পারেন তারা।
এখানে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে আমাদের মাঝে, বলেন করিম। বলা হয়, যদি তোমার দুটো সন্তান থাকে, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, এবং যেকোনো একজনকে যদি শিক্ষা দেওয়ার সমর্থ হয়, তবে অবশ্যই মেয়েটিকে শিক্ষিত করো।
কয়েকদিন বাদেই স্যুট পরে একটি বিশাল পাথরখণ্ডের ওপর চড়লেন ইসার আলী। তিনি পারিবারিক বিয়ের একটি অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত। সেখান থেকে গ্রামের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। বললেন সাম্প্রতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে। জানালেন, এই পরিবর্তনের অনেকটাই এসেছে শিক্ষা অর্জন থেকে। আমরা এখান ইউনিভার্সিটি বা অন্য শহরে যাচ্ছি। আবার অনেক কিছুই এসেছে এইটা থেকে, বলে নিজের ফোন নির্দেশ করলেন। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে এখানকার মানুষ যুক্ত হতে স্মার্টফোন ও মোবাইল ডেটা নেটওয়ার্কের ওপরই নির্ভর করছে। বললেন, যেদিন প্রথম শায়নাকে একটি শহরে দেখলাম, তখন আমার গ্রামে ২জি নেটওয়ার্ক এসেছে। আমরা মেসেজ চালাচালি করতে থাকলাম। বাড়িতে কেউ না থাকলে কথা বলতাম। আমাদের ঐতিহ্য কারো সঙ্গে থাকা পবিত্র বিষয়। তাই যখন আমরা ধীরে ধীরে সম্পর্ক এগিয়ে নিলাম, তার মাঝে কখনো বড়দের অসম্মান করিনি। ফোন থাক বকা নাই থাক, আমাদের রীতি-ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে।
আলী ও শায়নার বিয়ে হয়েছে। তবে বিয়ের রীতি ১০ বছর আগের থেকে অনেক আলাদা। আগে বাবা-মা ছেলে বা মেয়েকে পছন্দ করতেন। এখন আমরাই বলি কাউকে ভালো লেগেছে কিনা, বললেন আলী।
বিয়ে বাড়ির সামনে দুটো সারি। একটি পুরুষদের, অন্যটি মেয়েদের। সাদা পোশাকের এক বয়স্ক নারী অভ্যর্থনা জানালেন ম্যাথিউকে। তার মাথায় এম্ব্রোয়ডারি করা টুপি। তিনি ম্যাথিউয়ের ডান হাতটি নিয়ে তাকে চুমু খেলেন। ম্যাথিউ তাই করলেন। অভ্যর্থনা জানানোর ঐতিহ্যগত উপায়।
বাড়িটি মাটির। ভেতরে তরুণরা দাঁড়িয়ে আছেন খাবারের এক বিশাল পাত্রের চারদিকে। সেখানে ২০০ মানুষের জন্য রান্না করা হয়েছে ‘ব্যাট’। ভেড়ার মাংস এবং অনেক অনেক চা।
এই বিয়েতে নিমন্ত্রণ পাননি এমন অতিথিদের বিষয়ে আলাদা কিছু নেই। সেখানে যোগ দিয়েছে প্যারিস থেকে আসা ম্যাথিউয়ের দুই বন্ধু এমানুয়েলে এবং জুলিয়েন। তাদের দুই কন্যাও রয়েছে। ছুটি কাটাতে এসেছেন পাকিস্তানের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
এখান থেকে বাড়ি ফিরে কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, পাকিস্তানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাহাড়ঘেরা গ্রাম কেমন হতে পারে? কেউ কি এই চিত্র কল্পনা করতে পারবেন? এই স্থানটি সত্যিই আমার আত্মাকে আরো বেশি পরিপূর্ণতা দিয়েছে, বললেন ম্যাথিউ। এখানে যতবার এসেছি, গ্রামটি আমাকে ততই উষ্ণতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। গোজাল এমন এক উদাহরণ যারা আধুনিক বিশ্বে প্রবেশ করেছে নিজেদের ঐহিত্য সমুন্নত রেখে। এখানে যারাই আসবেন, তারাই কিছু না কিছু শিখে যেতে পারবেন। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
মন্তব্য চালু নেই