পাকিস্তানি ছাত্রীর ১৭ বছরের লড়াইয়ের কাহিনি
১৭ বছর আগের ঘটনা। ওয়াজিহা আরোজ। লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। ক্লাস থাকত সন্ধ্যায়। নিয়মিত ক্লাসে যান, পরীক্ষা দেন। নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো। দেখা গেল তিনি অনুত্তীর্ণ। কারণ, তিনি একটি পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এটি কীভাবে সম্ভব, নিজের কাছেই প্রশ্ন আরোজের। কারণ, তিনি সব পরীক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কথা কে বিশ্বাস করে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা আরোজের বাবাকে ডেকে বলেন, তিনি সম্ভবত মেয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। আর মেয়ে পরীক্ষায় সময় কোথায় ছিল তা খোঁজ নিতেও পরামর্শ দেন।
পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে একটি মেয়ের নামে এই কালিমা যে কতটা দুঃসহ, তা শুধু ওই নারী বা তাঁর পরিবারই জানে। সেখানে মেয়েদের খুব কড়াকড়ির মধ্য দিয়ে বড় করা হয়। সেখানে প্রেম করা তো গুরুতর অপরাধ। আর আরোজ যদি কোথাও একা গিয়েও থাকে, তাহলে অনুমান করা হচ্ছিল, সেখানে নিশ্চয়ই কোনো পুরুষ ছিল।
পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকার খবর মুহূর্তেই পৌঁছে যায় তাঁর পরিবার ও সহপাঠীদের কাছে। আরোজ সেই সময়ের কথা মনে করে বিবিসিকে বলেন, ‘এ খবর শোনার পর আমার দিকে মা-ও যেন কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাতেন। তাঁর চোখে ছিল সন্দেহ। আমার ঘনিষ্ঠ স্বজনেরা বারবার আমার কাছে জানতে চায়, আমি কেন পরীক্ষা দিইনি।’
তারপরও ক্লাস চালিয়ে যান আরোজ। কিন্তু এত দিনের সহপাঠীরাও যেন অচেনা হয়ে উঠল। সুযোগ পেলেই তারা টিটকারি করত। ক্লাসে তারা খুব বাজেভাবে বলত যে একজন তো পরীক্ষার অজুহাত দেখিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। আর কথাগুলো যেন আমার কান পর্যন্ত পৌঁছায়, তারা কথাগুলো সেভাবেই বলত।
আত্মীয়স্বজন ও পারিবারিক বন্ধুরা সন্ধ্যায় ক্লাসে যাওয়া নিয়ে আপত্তি করতে থাকে। এই গুজব ছড়াতে ছাড়াতে এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে সে সারা বছরই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অন্য কোথাও ছিল। আরোজ বলেন, ‘একসময় আমি এতটাই হতাশ হয়ে পড়লাম যে আত্মহত্যা করব বলে ভাবছিলাম।’
তারপরও দমে যাননি আরোজ। তিনি বিষয়টি নিয়ে লাহোর হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁর পরিবার তাঁকে সমর্থন দিয়েছে। আর তাঁর বাবা, যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক কিন্তু বর্তমানে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন, তিনি মেয়ের হয়ে লড়ছেন।
বিষয়টি আদালতে ওঠার চার মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর পরীক্ষার খাতা আদালতে উপস্থাপন করেন। কর্তৃপক্ষ জানায়, এই ভুল আসলে একজন অফিস সহকারীর। তিনি পরীক্ষার্থীদের উপস্থিতি তালিকা ঠিকভাবে যাচাই করেননি। এই পর্যায়ে আদালত রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবহেলাকে দায়ী করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভুল শুধরে নতুন করে ফল প্রকাশ করে।
কিন্তু এত দিন আরোজের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার চারপাশে যাদের মধ্যে আমি ছিলাম, তাদের কাছ থেকে সেই সম্মান ফিরে পাওয়া খুব কঠিন।’ তাই তিনি তাঁর সম্মান ক্ষুণ্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়ী করে মামলা করেন।
আদালতের রায় আরোজের পক্ষে গেলেও তাঁকে নিয়ে যখন এ গুজব ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাঁর পরিবার ভয় পাচ্ছিল মেয়ের ভালো বিয়ে হবে তো। তাই যত দ্রুত সম্ভব তারা মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আরোজ বলেন, তাঁর পরিবার প্রগতিশীল হলেও তাঁরা যে সমাজে ছিল, তা ছিল রক্ষণশীল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার চার মাস পরেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গ আরোজ বলেন, ‘আমার পরিবার মনে করল, দ্রুত বিয়ে হয়ে যাওয়া ভালো, তাহলে আমাকে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে না, মানুষের কাছ থেকে বিব্রতকর প্রশ্নও শুনতে হবে না।
আরোজের স্বপ্ন ছিল সিভিল সার্ভিসে কাজ করবেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। অথচ তাঁর দুই বোনের একজন পড়াশোনা করছে, অন্যজন বিচারিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।
বিয়ের কয়েক বছর পর আরোজ মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে কানাডায় পাড়ি জমান। এখন তাঁদের আরও দুই সন্তান হয়েছে। আরোজের আর পড়াশোনা করা সুযোগ হয়নি। তবে তিনি সুখেই আছেন বলে জানান।
আরোজের বাবা সগীর মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে আমার মেয়ের মামলাটিকে চ্যালেঞ্জ করে তা টানতেই থাকে। যুক্তিতর্ক শেষ করতেই কেটে যায় পাঁচ বছর। আর বাকি সময়টা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের পক্ষে প্রমাণ জোগাতে কাটায়।’
গত বছর লাহোরে একটি দেওয়ানি আদালত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আট লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে। এরপর এই মাসের শুরুর দিকে আপিল আদালত তা বহাল রাখেন। এ রায়কে চ্যালেঞ্জ করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সে সুযোগ এখনো রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুখপাত্র খুররুম শেহজাদ বিবিসিকে বলেন, ‘মামলাটি যেহেতু অনেক পুরোনো, তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথমে রায়ের বিস্তারিত দেখবে। আমরা যদি দেখি যে শিক্ষার্থীর আবেদন সঠিক তাহলে আমরা অবশ্যই আদালতের রায় বাস্তবায়ন করব। আর যদি বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক হয়, তাহলে আমরা আইনের জায়গা থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
ইসলামাবাদের কায়েদ-ই আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজের সাবেক পরিচালক ফারজানা বারি, যিনি মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত, তিনি বলেন, পাকিস্তানের সমাজ যেখানে বিভিন্ন দিক দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে, সেখানে সামাজিক কুসংস্কার/ট্যাবু থেকেই যাচ্ছে। আজকেও যদি কোনো ছাত্রীর সঙ্গে এমনটা হয়, তখনো সমাজের আচরণ একই হবে। তিনি আরোজকে অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে তিনি এত লম্বা সময় ধরে মালাটি চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য দেখে অবাক হন। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা থাকে না অথবা অল্পতেই তারা হাল ছেড়ে দেন।
আদালতের রায়কে সাধুবাদ জানিয়ে আরোজ বলেন, ‘আমার যে ভুল ছিল না, তা আমি শুধু সেই স্বীকৃতি চেয়েছি। তাই আমি এটাকে বিজয় হিসেবে দেখছি।’ তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় আমার স্বপ্ন ভেঙে দিয়েছে এবং এর জন্য কোনো দিন ক্ষমা চায়নি। তাদের কারণে আমার সম্মান ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সমাজে যে দুর্নাম রটেছে, তা কোনো অর্থ দিয়ে পূরণ সম্ভব নয়।’
মন্তব্য চালু নেই