পাঁচ বছর তালাবন্দি মা-ছেলে!

একাধারে পাঁচ বছর নির্জন কক্ষে বন্দি জীবন-যাপন করেছে মা ও তার শিশু সন্তান। সূর্যের মুখ দেখেনি তারা। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই বন্দি থেকেছে। তবে স্বেচ্ছায় নয় তাদের এভাবে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে।

ফেনী শহরের রামপুর শাহীন একাডেমী সড়কের জনাকীর্ণ এলাকায় বছরের পর বছর বিশালাকার একটি বাড়ির কক্ষে ভাইয়ের নিষ্ঠুরতার শিকার বোন ও তার শিশু সন্তানের খোঁজ নেয়নি কোন আত্মীয়-স্বজন।

অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করেছে তারা। স্থানীয় একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশেরে পর বুধবার বিকাল ৪টার দিকে ওই নারী ও তার শিশু সন্তানকে উদ্ধার করেছে ফেনী থানা পুলিশ।

ফেনী মডেল থানার ওসি মাহবুব মোর্শেদ জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে ইডেন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন জাহানআরা বেগম রোজী (৪৫)। স্বামী উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আবুল কালাম আজাদ ভূঞা। বর্তমানে তিনি সিলেট সদর উপজেলায় কর্মরত।

একমাত্র ছেলে মেহেদী ইসলাম জিমুনের জন্মের কিছুদিন পর ভেঙ্গে যায় আজাদ-রোজীর সংসার। সেই সঙ্গে যেন রোজী ও তার একমাত্র সন্তানের সব স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটে। খড়গ নেমে আসে মা-ছেলের জীবনে।

২০০৯ সালের শেষ দিকে তাদের শহরে শাহীন একাডেমী রোডে পৈত্রিক বাসার একটি কক্ষে আটক করে রাখেন রোজীর বড় ভাই শেরশাহ। তিনি ঢাকার ইস্কাটনে ব্যবসা করেন।

২ ভাই ৬ বোনের মধ্যে অপর ভাই শাহেনশাহ মানসিক ভারসাম্যহীন। এক বোন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বড় ভাইয়ের ভয়ে অন্য চার বোনের কেউই রোজীর খোঁজ নিতে আসেনি।

এই চার বোনের তিনজনই ঢাকায় থাকেন। অপরজন ফেনী শহরে বসবাস করেন। তিনি শহরের রামপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা।

শহরের বিশাল বাড়ীতে দুটি পাকা ঘরের একটিতে দীর্ঘদিন ধরেই তালা দেওয়া দেখতে পান এলাকাবাসী। এই ঘরে শেরশাহ মাঝেমধ্যে আসতেন বলে স্থানীয়রা জানান। অন্যঘরের দুটি কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়। ভাড়ার চার হাজার টাকা দিয়ে চলে রোজী ও তার সন্তানের ভরন-পোষণ সব।
ভাড়াটিয়ারা জানান, তালাবন্ধ ওই কক্ষের জানালা দিয়ে চাল-ডালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হতো মা-ছেলেকে। এভাবেই কোনক্রমে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে তাদের। কেননা ভাড়াটিয়ারা না থাকলে ওদের মাঝে মাঝে না খেয়েই থাকতে হয়েছে।

ভুতুড়ে ওই কক্ষের ভিতরে একটি লাইট থাকলেও ইলেকট্রিক পাখাটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। কক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস না থাকায় উৎকট গন্ধ বের হয়। ফুটফুটে জিমুন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে। এক প্রতিবেশী জানান, একসময়ে ছেলেটি বেশ চঞ্চল ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন বন্দি থাকায় ধীরে ধীরে শারিরীক প্রতিবন্ধি হয়ে যাচ্ছে।

তারা আরও জানান, সব হারিয়ে রোজিও এখন মানসিক প্রতিবন্ধী। কেউ আসলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। তবে জিমুন ভিতর থেকে কথা বলার চেষ্টা করে। পাশের ভাড়াটিয়াদের থেকে জানালা দিয়ে সংগ্রহ করে পত্রিকা ও নানা রকম বই পড়ে। এক ভাড়াটিয়া জানায়, জিমুন অত্যন্ত মেধাবি। কোন ধরনের বই পেলে সহজে মুখস্ত হয়ে যায় তার।

রতিবেদককে জিমুন জানায়, পড়ালেখার প্রবল আকাঙ্খা থাকলেও সে প্লে-নার্সারির পর আর পড়তে পারেনি। কথা বলতে চাইলেও মায়ের বাধায় জিমুন থেমে যায়। একপর্যায়ে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেয়। এতে লেখা রয়েছে- ‘আমি মেহেদি ইসলাম। আমার আম্মুর সঙ্গে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত পাঁচ বছর যাবত আমার মামা অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছে। পড়তে চাই, আমি খেলতে চাই। আমি মুক্তি চাই।’

এ ব্যাপারে শেরশাহসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।

ফেনীতে বসবাসকারী রোজীর বোন রামপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা নুরের সাফা নিলুর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তার স্বামী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা নুর ইসলাম ফোন রিসিভ করলেও এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, পৈত্রিক সম্পত্তি আত্মসাৎ করতেই শেরশাহ শিশু সন্তানসহ তার বোনকে মানসিক প্রতিবন্ধি সাজিয়ে তালাবন্দি করে রেখেছিল।

ফেনী মডের থানার ওসি মাহবুব মোর্শেদ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।



মন্তব্য চালু নেই