দেশি-বিদেশী চাপ আমলে নিচ্ছে না

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভাবছে আ’লীগ

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকারের অনুকূলে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। আর এ জন্যই আলোচনার উদ্যোগ কিংবা বিদেশীদের সংলাপকে গুরুত্ব দিচ্ছে না দলটি।

আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান অবরোধ-হরতালের শুরুর দিকে সরকারের মধ্যে চাপা অসন্তোষ ছিল। বিশেষ করে অবরোধ-হরতাল চলাকালীন পেট্রোলবোমা ও আগুনে প্রতিদিনই একাধিক সাধারণ মানুষ পুড়ে মরছিল, বার্ন ইউনিটে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছিল। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। কিন্তু অবরোধের ৫৪তম দিনে এসে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, বর্তমানে পেট্রোলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা কমেছে। হতাহতের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক কম। তাই এখন আর সেই অস্বস্তি কিংবা অসন্তোষ নেই।

এর কারণ হিসেবে আওয়ামী লীগের তিনজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, অবরোধের শুরুতে সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়েছিল। প্রতিদিন পেট্রোলবোমায় মানুষ মারা যাচ্ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টারি মানবাধিকার কমিটি, জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থা বাংলাদেশের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ সহিংসতা রোধে বিরোধী দলসমূহের সঙ্গে সংলাপের জন্যও সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এত তাড়াতাড়ি উন্নত হবে এটা আওয়ামী লীগও ভাবেনি।

আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেন, মাহমুদুর রহমান মান্নার টেলিসংলাপ ফাঁস বিরোধী দলের আন্দোলন ও সংলাপের বিরুদ্ধে সরকারের হাতে শক্ত একটা অস্ত্র এনে দিয়েছে। এখন আর সহজে কেউ সংলাপের কথা বলবে না। বিদেশীদেরও আন্দোলনের নামে চক্রান্তের কথা প্রমাণসহ দেখানো যাবে।

আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ  বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের চালানো নাশকতা ও জঙ্গি কার্যক্রমের প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করে আমরা বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করছি। প্রামাণ্যচিত্রগুলো বিদেশের দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। এতে করে সারাবিশ্ব জেনেছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য কোনো আন্দোলন হচ্ছে না। সারাবিশ্ব যেমন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে, বাংলাদেশও তেমনি এ দেশের জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে।’

আওয়ামী লীগের নেতারা আরও জানান, বিএনপির অবরোধ আর এখন কার্যকর নেই। অবরোধের চলাকালে হরতাল দিয়েও বিএনপি-জামায়াত আন্দোলন জমাতে পারছে না। ফলে দেশের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হরতাল-অবরোধের মধ্যেও গাড়ি চলছে।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এসএসসি পরীক্ষা কেন পেছানো হচ্ছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে ড. হাছান মাহমুদ  বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত চক্র পরীক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পারে। আমাদের নেত্রী পরীক্ষার্থীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তা পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য নয়, বরং এটা পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে করা হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ  বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে বিদেশীদের কোনো চাপ নেই। বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ জানিয়ে আসছিল। এখন সহিংসতা নেই। জনগণ অপশক্তিকে প্রতিরোধ করেছে।’

সরকারের অভিযোগ, বিএনপি আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র যেমন শান্তির জন্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে সংলাপ করে না, তেমনি সরকারও সহিংসতা নিরসনে বিএনপি-জামায়াতের জঙ্গিদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। কঠোর হস্তে এই জঙ্গি কার্যক্রম ও নাশকতা দমন করবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম  বলেন, ‘জঙ্গিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হতে পারে না। আলোচনা শুধুমাত্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হবে এবং সেটা ২০১৯ সালে। তখন সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট নেই। জঙ্গিরা চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। এগুলো অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশীরা বিএনপি-জামায়াত চক্রের নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য বার বার উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। আমাদের প্রশাসন ও দেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা রুখে দিয়েছে। দু-একটি চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। এগুলোও আশা করি বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্যই বিদেশীরা আমাদের আর সংলাপের জন্যও বলছে না।’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম  বলেন, ‘কোথায় হরতাল, কোথায় অবরোধ। সারাদেশের কোথাও আর বিএনপির আন্দোলন নেই। বিএনপির আন্দোলন জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।’

তিনি বলেন, ‘বিএনপি ভেবেছিল, বিদেশীরা তাদের ক্ষমতায় এনে দিবে। কিন্তু জঙ্গিদের সঙ্গে কোনো বিদেশী রাষ্ট্র থাকতে পারে না। এটা এখন বিদেশীরা বুঝতে পেরেছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বন্ধুরাও এখন শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।’

তবে সরকারের এমন দাবির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নুরুল আমিন বেপারি  বলেন, ‘সারাবিশ্ব সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে। এই সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বে বলেছিল, ৫ তারিখের নির্বাচন হবে নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচন হওয়ার পরে সরকার নতুন নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। তারা দেশে ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছে।’

ড. বেপারি বলেন, ‘বিদেশীরা তো আর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে না। তারা তাদের মতো করে কূটনৈতিক ভাষায় সরকারকে সংলাপের জন্য বলছে। এখন যদি সরকার সংলাপের উদ্যোগ গ্রহণ না করে তাহলে তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ নিবে। হয়ত জাতিসংঘ সেক্ষেত্রে আরও তৎপর হতে পারে।’

বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আহমেদ আযম  বলেন, সর্বৈব মিথ্যা। যেখানে গণতন্ত্রের সামান্য সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে। সর্বশেষ তিনটি বার নির্বাচনই এর প্রমাণ। টাঙ্গাইল জেলা বার সমিতি, ঢাকা ট্যাক্সেস বার এ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা বার সমিতির নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, জনগণ বিএনপির আন্দোলনে সাড়া দিয়ে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানাচ্ছে। চাপ দিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ গাড়ি রাস্তায় নামিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করছে সরকার। সংসদের প্রধানমন্ত্রী হরতাল-অবরোধের ক্ষতির তথ্য দিয়েই প্রমাণ করেছেন বিএনপির আন্দোলনে জনগণ রয়েছে। এই সরকারের পতন না ঘটা পর্যন্ত বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।দ্য রিপোর্ট



মন্তব্য চালু নেই