পতিতাবৃত্তি ও ধর্ষণ থেকে বাঁচার একমাত্র পথ যখন বিয়ে!
দারিদ্র্য আর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা থেকে মুক্তির আশায় স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী রোহিঙ্গা তরুণী শহীদা ইউনূস। মিয়ানমারে মুসলিম বিরোধীরা ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পর এ বছরই মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। তবে স্বপ্ন পূরণের সেই প্রলোভনে সাড়া দিতে গিয়ে কখন যে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছেন তা টেরই পাননি শহীদা। তারপর একদিন নিজেকে আবিষ্কার করলেন থাইল্যান্ডের জঙ্গলের একটি পাচার শিবিরে।
এরপর পাচারকারীরা ১,২৬০ ডলার মুক্তিপণ চেয়ে বসে শহীদার কাছে। দরিদ্র পরিবার সেই মুক্তিপণ শোধ করতে পারবে না সেটা আগেই টের পেয়েছিলেন তিনি। আর তা শুনে মুক্তিপণ আদায়ে বিকল্প একটি প্রস্তাব দিয়ে বসে পাচারকারীরা। তারা জানায়, তাদের চেনাজানা এমন একজন লোক আছে যাকে বিয়ে করলে ওই লোক শহীদার মুক্তিপণ শোধ করে দেবে।
শেষ ভরসা হিসেবে পরিবারকে ফোন দেন শহীদা। পরিবার জানায়, ‘চাইলে বিয়েটা করে ফেলতে পার। সেটাই পরিবারের সবার জন্য ভালো।’
উপায়ন্তর না দেখে বিয়েতে রাজি হয়ে যান শহীদা। শহীদা এখন তার ৩৮ বছর বয়সী স্বামীর সঙ্গে পেনাং দ্বীপে বসবাস করছে। দ্বীপটিতে তার সঙ্গে রয়েছেন আরো ১৭ রোহিঙ্গা অভিবাসী। শহীদা বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে বিয়ে করেছি কারণ পাচারকারীদের টাকা প্রয়োজন ছিলো। তা শোধ না করলে আমাকে হয়তো ধর্ষণেরও শিকার হতে হতো। এর চেয়ে একজন রোহিঙ্গাকে বিয়ে করাই ভালো।’
কেবল শহীদাই নয়, পাচারের শিকার হওয়ার পর বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়েছে এমন শত শত নারীকে। কেউ কেউ এড়িয়ে যেতেও সক্ষম ছিলেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই নগন্য। মানব পাচারের শিকার হয়ে জোরপূর্বক বিয়েসহ নানা হয়রানির শিকার সেইসব নারীর কষ্টের কথাগুলো তুলে ধরা হয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে।
পতিতাবৃত্তি এড়াতে বিয়েতে বাধ্য হন নারীরা
নিবন্ধে বলা হয়, ঠিক কতজন নারী এমন প্রতারণায় পা ফেলেছেন তা কারো জানা নাই। কর্মকর্তাদের ধারণা হাজার না হলেও শত শত নারী এমন অবস্থার শিকার। জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের বরাতে নিবন্ধে বলা হয়, এ বছর মিয়ানমার ও বাংলাদেশে থেকে সমুদ্রপথে হাজারো অভিবাসী পাড়ি দেয়ায় এই প্রকার অপহরণ ও বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে।
রোহিঙ্গা শরনার্থীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ফর্টিফাই রাইটস এর নির্বাহী পরিচালক ম্যাথিউ স্মিথ জানান, হাজার না হলেও শত শত নারীকে জোর করে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে কিংবা বিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু পরিবারে এমন সিদ্ধান্তকে বেঁচে থাকার উপায় বলে ধরে নেয়া হয়। আর এমন অসহায়ত্বকেই ব্যবসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মানবপাচারকারী চক্রগুলো। আর বিয়ে দিয়ে দেয়াটা আসলে সবচেয়ে কম ভয়াবহ পরিণতি বলে জানান ম্যাথিউ স্মিথ।
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী শরীফা শাকিরা। তিনি শরণার্থীদের আবাসন নিয়ে কাজ করে থাকেন। তিনি বলেন, আটককৃত নারীরা ভয়ে থাকে যে তারা যদি সময়মতো স্বামী খুঁজে না পায় তবে তাদের হয়তো ভারত বা থাইল্যান্ডে পতিতাবৃত্তির জন্য বিক্রি করে দেয়া হতে পারে।
অনেক সময় পরিবারের চাপে পরে এমন পথে পা বাড়ায় মেয়েরা। প্রতারক চক্র বিভিন্ন রকম প্রলোভন ও প্রস্তাব দিয়ে পরিবারকে তাদের মেয়েকে দেশের বাইরে পাঠাতে প্রলুব্ধ করে। তারা জানায় মালয়েশিয়ায় গেলে তাদের জন্য অনেক সুখের জীবন অপেক্ষা করছে।
কিন্তু বাস্তবে এমন কোনো নারীই নেই যাকে টাকা ছাড়া মুক্তি দেয়া হয়। মেয়েদেরকে নৌকায় বা কোনো ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের মুক্তিপণ মেলে, আটক অবস্থাতেই কাটাতে হয় দিন। আর যদি পাচারকারীরা বুঝতে পারে যে মেয়েটির পরিবার মুক্তিপণ দিতে অক্ষম তবে তারা অন্য কাউকে জানায় যে তাদের কাছে এমন একজন মেয়ে আছে।
অসম বয়সের বিয়ের বেড়াজালে পড়তে বাধ্য হন পাচারের শিকার নারীরা
নিবন্ধে বলা হয়, পাচারকারী থেকে বাঁচতে কিছু কিছু নারী অসম এবং অসুখী সম্পর্কের বেড়াজালে আটকা পড়ে যায়। স্বামীরা বেশিরভাগ সময়ই বয়স্ক এবং দরিদ্র হয়ে থাকে।
নিবন্ধে বলা হয়, দুই বছর আগে আম্বিয়া খাতুন নামে এক নারী মালয়েশিয়ায় একজনকে বিয়ে করেন যে তার মুক্তিপণের জন্য ১ হাজার ডলার মুক্তিপণ দিয়েছিলেন। ২১ বছর বয়সী আম্বিয়ার তুলনায় বয়সে বেশ বড় হলেও তাকে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আম্বিয়ার। আম্বিয়া বলেন, ‘আমাকে উদ্ধারের পর আমার স্বামী আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি তাকে বিয়ে করবো কিনা। যদি বিয়ে করতে না চাও তবে আমাকে আমার টাকা ফেরত দাও যা আমি তোমার পেছনে খরচ করেছি।’
কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায় আম্বিয়া। কারণ মালয়েশিয়ার ভাষা পর্যন্ত জানা নেই আম্বিয়ার, তাই কাজ করে তার টাকা পরিশোধ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাকে সাহায্য করার মতো কোনো আত্মীয়ও নেই যে তাকে উদ্ধার করতে পারে। অগত্যা বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হয় আম্বিয়া।
মিয়ানমার থেকে নার্সিং শেখার আশায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল আম্বিয়া। কিন্তু এখন তার বসবাস কুয়ালালামপুরের একটি মফস্বল এলাকায়। ছোট একটি বাড়িতে মা, অসুস্থ বোন ও বোনের সন্তানকে দেখাশোনা করেই সময় কাটে তার। কয়েকমাস আগে তার স্বামীও নিখোঁজ হয়ে যায়। কাজের সন্ধানে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি সে।
২০১২ সালে মিয়ানমারে মুসলিম বিরোধীদের হামলায় আম্বিয়ার স্বামী মারা যায় বলে জানায় তার মা মাবিয়া খাতুন। তিনি বলেন, তখন আম্বিয়াকে যৌন ব্যবসায় বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
পাওয়া গেছে বিয়ে নিয়ে পাচারের শিকার নারীদের সঙ্গে দালালের ফোনালাপের রেকর্ড
নিবন্ধে বলা হয়, পাচারকারীদের টাকা দিয়ে যেসকল পুরুষ বিয়ে করে তাদের কেউই এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। কিন্তু ফোর্টিফাই রাইটস এর অনুসন্ধানে একটি ফোনালাপের রেকর্ড পাওয়া গেছে। সেখানে একজন দালালের সঙ্গে এক রোহিঙ্গা নারীর কথোপকথন হয়। দালাল মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে যে তার বিয়ে হয়েছ কিনা। মেয়েটি হয়নি জানালে সে বলে তার কাছে একজন আছে যে ৭৮০ ডলার মুক্তিপণ দেবে এবং তাকে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেবে, এতে সে রাজি কিনা। উত্তরে মেয়েটি বলে যদি ইশ্বরের তাই ইচ্ছে হয় তবে তিনি রাজি।
মেয়েটি রাজি হয়ে যাবার পরে দালালটি ক্যাম্পের নিরাপত্তাকর্মীকে জিজ্ঞাসা করে এমন আরো কোন মেয়ে আছে কিনা যারা বিয়ে করতে চায়। এরপর তাকে একটি তালিকা দেন ওই গার্ড।
তবে কথোপকথনে যতটা সহজ ছিল, বাস্তবজীবনে ব্যাপারটি এতটা সহজ নয়। রোহিঙ্গা নারীরা যে সমাজ থেকে আসে সে সমাজে বিয়েটা আগে থেকেই ঠিক করা হয়। কিন্তু তাদের গ্রামে যেন এমন অবস্থা যে দালালদের ঠিক করে দেয়া পুরুষকেই স্বামী হিসেবে গ্রহণ করাটাই স্বাভাবিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় আগেই বিয়ে দিয়ে মালয়েশিয়ায় মেয়েদেরকে পাঠায় তাদের পরিবার।
কেন এই জোরপূর্বক বিয়ে?
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুসান নিবোন জানান, মিথ্যা আশা সহিংসতা এবং হুমকির কারণেই এসকল বিয়ে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘পাচারের ঘটনা আসলে ক্ষমতার অপচর্চা। এই নারীদের নিজ স্থানেই খুব বেশি স্বাধীনতা নেই। এবং এ কারণেই তারা অন্যদেশে পাড়ি দেয়াটাকে উপায় বলে মনে করে।’
২০১২ সালে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে মুসলিমবিরোধী সহিংসতার পর বেশিরভাগ শরনার্থীই ছিল পুরুষ। তবে গেল দুই বছরে নারী ও শিশুর সংখ্যাও বেশ বেড়ে গিয়েছে।
মিয়ানমারে এখন খুব বেশি রোহিঙ্গা পুরুষ না থাকাও এর একটি কারণ বলে মনে করেন ব্যাংককে রোহিঙ্গা অধিকার সংস্থার ক্রিস লেওয়া। তিনি বলেন, পুরুষ স্বল্পতার কারণে যৌতুকের হারও বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। গেল বছর থেকে এ বছর পর্যন্ত অন্তত ৫ হাজার কমবয়সী নারী নৌকায় চেপে মিয়ানমার ত্যাগ করেছে এবং শেষপর্যন্ত বিবাহিত অবস্থায় মালয়েশিয়া এসে পৌঁছেছে।
এখনও হয়নি সঙ্কটের অবসান
তবে কিছুদিন এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নড়েচড়ে বসায় এবং বৈরি আবহাওয়ার কারণে সমুদ্র পথে বন্ধ রয়েছে এই মানবপাচার। কিন্তু এ অবস্থায়ও কিছু রোহিঙ্গা নারী অপেক্ষা করছেন তারা বিয়ে করে মালয়েশিয়া পাড়ি দেবেন। কয়েক মাস আগে তাহেরা বেগম নামে আরেক নারী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসে। সে বাংলাদেশে কুতুপালং এ এক আত্মীয়ের সঙেগ্ বাস করতো। ১৮ বছর বয়সী এই নারী অপেক্ষায় ছিলো কোন পুরুষ তাকে বিয়ে করে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায়।
সে এখনো পুরুষটির ছবিও দেখেনি। কিন্তু ফোনে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। তিনি বলেন, আমি যখন তার সঙ্গে কথা বলি, সে জানায় সে চাকরি করে এবং ভালোই উপার্জন করে। আমি মিয়ানমারে থাকতে পারলেই খুশি হতাম কিন্তু আমার ভাই চায় আমি যেন মালয়েশিয়ায় চলে যাই।’
মন্তব্য চালু নেই