নিরক্ষর দুই বর্গা ম্রো শিক্ষক দিয়ে চলছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান
মোহাম্মদ শামছুদ্দোহা, জেলা প্রতিনিধি, বান্দরবান॥ ম্রো সম্প্রদায়ের ১৩টি পাড়ার ছেলে-মেয়েদের এক মাত্র প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লেমুপালং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। বান্দরবান পার্বত্য জেলার লামা উপজেলা সদর থেকে ৫৭ কিলোমিটার ও সরই ইউনিয়নের ক্যায়াজু পাড়া বাজার থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত নব জাতীয় করণকৃত এই বিদ্যালয়। স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠির প্রচেষ্টায় ১৯৯১ইং সনের ১৮ মে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।
সরই ইউনিয়নের লেমু পালং মৌজার মিতাং মেম্বার পাড়া, নোয়া পাড়া, লাংগি পাড়া, জোইয়ান পাড়া, বাক্কা পাড়া, মংলাই পাড়া, দেওয়ান পাড়া(নতুন) ও দেওয়ান পাড়ার (পুরাতন) ৩ শতাধিক ম্রো শিশু বিদ্যালয় গমন উপযোগী। শিক্ষকদের লাগাতার অনুপস্থিতি ও এলাকায় বিকল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় যুগের পর যুগ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে বর্ণিত পাড়া সমূহের কোমলমতি শিশু কিশোররা। বেতন কম অজুহাতে শিক্ষকগণ বেসরকারী থাকা কালিন বিদ্যালয়ে লাগাতার অনুপস্থিত থাকতেন। জাতীয়করনের পর বিদ্যালয়ের অবস্থান অনেক দূরে এবং সেখানে অবস্থান করে শিক্ষকতা করার কোন পরিবেশ নাই অজুহাতে বিদ্যালয়ে লাগাতার অনুপস্থিত থাকছেন প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকগণ। চলতি শিক্ষা বর্ষে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীতে কোন শিক্ষার্থী নাই। ৩য় শ্রেণীতে ৬ জন, ১ম এবং ২য় শ্রেণী মিলে ১৮জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। অবশ্যই শিক্ষা অফিসে দাখিলকৃত রিপোর্ট অনুযায়ী দেড় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী থাকার কথা। গত ২০১৪ শিক্ষা বর্ষে বহিরাগত প্রতিষ্ঠানে লেখা পড়া করে এমন ২জন শিক্ষার্থী ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় বিদ্যালয়ের নামে অংশ গ্রহন করে ১জন পাস করেছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মিতাং ম্রো বলেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা সরকার দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের অনুপস্থিতি এবং অবহেলায় পিছিয়ে পড়া ম্রো জনগোষ্ঠির ছেলে মেয়েদের ভাগ্যে লেখাপড়ার সুযোগ মিলছেনা। বিদ্যালয়ের সভাপতি বলেছেন, প্রধান শিক্ষকের হাত অনেক লম্বা, সে বিদ্যালয়ে না আসলেও কাগজে পত্রে স্বাক্ষর করার জন্য প্রভাবশালীরা চাপ প্রয়োগ করেন।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার আকতার উদ্দিন উক্ত বিদ্যালয় পরিদর্শন কালে সর্বোচ্চ ১১ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত পেয়েছেন। তবে কোন শিক্ষককে উপস্থিত পাননাই। স্থানীয়রা জানিয়েছেন সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫ম শ্রেণী হতে ঝড়ে পড়া এমন ২জন কিশোর বিদ্যালয়ে বর্গা শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছে। তাদেরকে প্রধান শিক্ষক মোঃ ইসহাক মাসে ২ হাজার টাকা করে প্রদান করেন।
জানাগেছে, বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সিরাজ উদ্দৌলা পিটিআই এ প্রশিক্ষণরত। আয়শা সিদ্দিকা নিজের সুবিধার জন্য ডলুছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে। সরওয়ার কামাল লোহাগাড়া উপজেলার পুটিবিলায় অবস্থান করেন। তিনি সেখানে জনপ্রতিনিধিত্বসহ সামাজিক কর্মকান্ড ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। মাঝে মধ্যে সখের বশে বা বিশেষ প্রয়োজনে বিদ্যালয়ে আসেন। প্রধান শিক্ষক মোঃ ইসহাক লোহাগাড়ার গোরস্থানে অবস্থান করে ব্যবসা বানিজ্য ও অন্যান্য কাজ কর্ম করেন। মাঝেমধ্যে মোবাইলে বর্গা শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ২ ম্রো কিশোরকে বিদ্যালয়ের খোজ খবর নেয়ার জন্য তাগিদ দেন। ছাত্র-ছাত্রী সর্ম্পকে ভূল তথ্য শিক্ষা অফিসে দাখিল করে যাচ্ছেন। নিজের পছন্দ মত চলার জন্য কাগজে কলমে ম্রোএকজনকে সভাপতি দেখিয়ে রেখেছেন। বিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষগুলোতে গাছ ও বাঁশ ব্যবসায়ীরা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে। এই প্রতিনিধিকে প্রধান শিক্ষক মোঃ ইসহাক ভূলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, তিনি বদলির চেষ্টা করছেন।
উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার আকতার উদ্দিন বিদ্যালয়ের এ পরিস্থিতি দেখে আক্ষেপ করে বলেছেন,বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিসার যতীন্দ্র মোহন মন্ডল বলেছেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মার্চ মাসের বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে।
লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খালেদ মাহমুদ বলেছেন, এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকগন বিদ্যালয়ে লাগাতার অনুপস্থিতি থেকে কিভাবে সরকারী বেতন ভাতা পায় তা আমার বোধগম্য হচ্ছেনা। এ বিদ্যালয়ের শিক্ষকগন বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে চাকুরী করার চেয়ে তদবির করে বেতনর ভাতা গ্রহন ও সময় পার করতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে।
মন্তব্য চালু নেই