নিঃশ্বাসে আগুনের গোলা!
পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান আছে, যেখানে আগুনের গোলার মতো লাগে নিঃশ্বাস। আগুনের গোলার নিচে পা পড়লে যেমন ঝলসে যায়, বাতাসও যেন এসব স্থানে আগুনের গোলার মতো শ্বাসনালী আর দেহেজুড়ে অঙ্গারের যন্ত্রণা তেরি করে। এসব স্থানে তাপমাত্রা এতটাই প্রখর যে, মনে হয় নিঃশ্বাসে স্বস্তির বাতাস নয়, আগুনের হলকা ঢুকছে ফুসফুসে। পুড়ে যাচ্ছে শ্বাসনালী। আর পুরো শরীর যেন জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে ভাজা হচ্ছে। তবে এই স্থানগুলো পৃথিবীর শুরু থেকেই এমন দাবদাহে পুড়ছে আর পোড়াচ্ছে, বিষয়টি সব সময় এমন নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এসব স্থান উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয়ে এখন বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠেছে। এমন কিছু শুষ্ক, রুদ্র স্থান নিয়ে এই আয়োজন।
প্যারিসে চলছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ২১। বিশ্বের উষ্ণায়ন রোধে করণীয় ঠিক করতে বসেছেন বিশ্বনেতারা। উষ্ণায়ন মানুষের অস্তিত্বের জন্য যে কতটা ভয়ংকর হুমকির বার্তা দিয়ে থাকে, তা এই লেখায় কিছুটা আন্দাজ করা যাবে বৈকি।
ডালোল, ইথিওপিয়া
ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চলে (প্রচ- উষ্ণাঞ্চল) অবিস্থত ডালোল। এখানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এখানকার প্রতিদিনের গড় তাপমাত্রা ছিল ৯৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। দিনের বেলা তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রির ওপরে উঠে যেত। তারপর ডালোলে আরো কখনো বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেওয়া যায়নি। তাপমাত্রা খুব কমেনি, বরং এখন সারা বছর এই তাপমাত্রা প্রায় অব্যাহত থাকে।
ডালোল এখন ভুতুড়ে শহর। তবে ১৯৬০-এর দশকেও এখানে খনিশ্রমিকদের বসতি ছিল। তীব্র তাপমাত্রা অব্যাহত থাকায় জনবসতি হারিয়ে গেছে। মানবসৃষ্ট সৌন্দর্য এখানে নেই বললেই চলে। তবে তাপীয় জলের স্ফটিকস্তুূপ (বরফের মতো কিন্তু ঘন গরম পানি) দেখার মতো। জীবনের ঝুঁকি থাকলেও সাহসী পর্যটকরা এখানে ভ্রমণে গিয়ে থাকেন, তবে অনেক সাবধানে।
ডালোলের আকাশে গনগনে সূর্য জ্বলে আর মাটি থেকে বের হয় আগুনের হলকার মতো তাপ। এটি একটি সক্রিয়া আগ্নেয়গিরি অঞ্চল, যা আগ্নেয়গিরির মতোই তাপ বিকিরণ করে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
তিরাত জভি, ইসরায়েল
ইসরায়েলে ইহুদিদের দলবদ্ধ হয়ে এক এলাকায় বসবাসের প্রাচীন ব্যবস্থাকে বলে কিব্বুৎজ। টিরাট জভি এমন একটি কিব্বুৎজ। ইসরায়েলের বেইট শে’আন উপত্যকায় এর অবস্থান, যা সমুদ্রসমতল থেকেও ৭৭২ ফুট নিচে অবস্থিত।
পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জর্ডান নদী এলাকাটি উর্বর রেখেছে ঠিকই কিন্তু যখন গ্রীষ্মকাল আসে তখন জ্বলন্ত সূর্য যেন মাথার ওপর নেমে আসে। প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন আগুনের গোলার মতো শ্বাসনালী ঝলসে দেয়, গদ্ধ করে। ১৯৪২ সালে এখানকার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১২৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যা ছিল এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। শীতকালে এক প্রকার জীবন ধারণ করা গেলেও গ্রীষ্মে শরীর জিইয়ে রাখতে হয় পানিতে। এখানকার বাড়িগুলোর চারপাশে শামিয়ানার নিচে দেখা যায় দেহ এলিয়ে পড়ে আছে লোকজন।
তিমবুকতু, মালি
ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ তিমবুকতু শহর। এক সময় জ্ঞানীদের তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হতো এটি। প্রাচীন শাহারা অঞ্চলের বাণিজ্য পথগুলোর মাঝখানে এর অবস্থান হওয়ায় সবার আগ্রহের স্থান ছিল এটি। বিশেষ করে মুসলিম প-িত ও ধর্মপ্রাচারকরা তিমবুকতু শহরের কেন্দ্র করে আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েন।
তিমবুকতুতে এখনো মনুষ্য বসতি আছে এবং বিশ্বের প্রাচীন হস্তলিখনের বিপুল সম্ভার সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। তবে দুঃখের বিষয় হলো- তিমবুকতু এখন সাহারা মরুভূমির অংশে পরিণত হয়েছে। শহরজুড়ে বিশাল বিশার বালিয়াড়ি তৈরি হয়েছে এবং পথঘাট বালিঝড়ে প্রায়ই বালির স্তুূপে ঢেকে যায়। এখানকার তাপমাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তবে আশার কথা হলো, তিমবুকতুর ২১ কিলোমিটার দূর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নাইজার নদী।
কেবিলি, তিউনিশিয়া
তিউনিশিয়ার কেন্দ্রাঞ্চলের একটি মরুদ্বীপ কেবিলি। এখানে তাপের তীব্রতা এত বেশি যে, ঠাট্টা করে বলা হয়ে থাকে, উত্তর আফ্রিকার তাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য লোকজন কেবিলিতে যায়।
উচ্চ তাপমাত্রা এখানকার আবহাওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য। দিনের বেলা থার্মোমিটারের পারদ ১৩১ ডিগ্রিতে উঠে যায় অনায়াশে, যা আফ্রিকায় রেকর্ডকৃত তাপমাত্রার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ার পরও সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে কেবিলিতে। যত দূর জানা যায়, ২ লাখ বছর আগে এখানে মানব বসতি ছিল। কিন্তু মরুকরণের প্রভাবে কেবিলির সভ্যতা এখন হুমকির মুখে।
রাব’আল খালি, আরব উপদ্বীপ
বিশ্বের বালুময় সক্রিয় মরুভূমির মধ্যে রাব’আল খালি সবচেয়ে বড়। আরব উপদ্বীপের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে অবস্থিত রাব’আল খালির মরুকরণ এখনো চলছে। সৌদি আরব, ওমান, ইয়েমেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে পড়েছে এটি।
রাব’আল খালির আবহাওয়া সব সময় শুষ্ক ও গরম থাকে। এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই বালুকা বেলায় তৃষ্ণা মেটাতে এক ফোঁটা জল পাওয়া যায় না। বছরে গড় বৃষ্টিপাত মাত্র ১ দশমিক ২ ইঞ্চি, যা আকাশ থেকে ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তপ্ত বালুর বুকে হারিয়ে হায়। রাব’আল খালির আবহাওয়া এতটাই নিষ্ঠুর যে, নিঃশ্বাসে গরম বাতাস ঢুকে মৃত্যু যন্ত্রণা দেয়। ২০১৩ সালে আগে পায়ে হেঁটে এই মরুভূমি পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সালে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি দল বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে রাব’আল খালি প্রথম পাড়ি দেয়।
মন্তব্য চালু নেই