নারীর মা না হওয়ার অন্তরায় ‘ফাইব্রয়েড’

নারীদের প্রজননক্ষম বয়সে জরায়ুতে সবচেয়ে বেশি যে টিউমারটি হয়ে থাকে তা হল ‘ফাইব্রয়েড’ বা ‘মায়োমা’। ‘ফাইব্রয়েড’ নারীদের শরীরে মাতৃত্ব ধারণের অন্যতম শত্রু। এ সমস্যা নিয়ে কিছুদিনে আগে মিতালি চট্টোপাধ্যায় নামের এক নারী তার শাশুড়ি অপর্ণা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার চেম্বারে এসেছিলেন। মিতালির সমস্যা বার বার মিসক্যারেজ (অকাল গর্ভপাত)। মিতালির জরায়ুর অন্তঃত্বকে বেশ কয়েকটি ‘ফাইব্রয়েড’ থাকার জন্যই বার বার গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে। যদিও শাশুড়ির ধারণা ছিল, একটু বেশি বয়সে মা হতে চাইছে বউমা, তার ওপর চাকরিজীবী হওয়ার দৌড়ঝাঁপ করায় হয়তো বার বার মিসক্যারেজ হয়ে যাচ্ছে। মিতালি ও তার শাশুড়িকে আমি যে দু’টি বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলাম তা হল—

১) ‘ফাইব্রয়েড’ এক ধরনের টিউমার হলেও এ থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশেরও কম।

২) অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপারেশন না করেই এর চিকিৎসা করা সম্ভব এবং সন্তান নেওয়ার আগে অপারেশন না করে শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেই হবে। জরায়ুতে ছুরি-কাঁচি চালানোর আগে হরমোন থেরাপি বা অন্য কোনো ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া গর্ভবতী মা ও সন্তান উভয়ের পক্ষে নিরাপদ এবং মঙ্গলজনক। তবে সন্তান প্রসবের পর ‘ফাইব্রয়েড’ সারিয়ে ফেলতে হবে।

‘ফাইব্রয়েড’ কি এবং কোথায় সৃষ্টি হয়?

১‘ফাইব্রয়েড’ হল নারীদেহের অত্যন্ত কমন টিউমার। নীরবে ও সন্তর্পণে বিভিন্ন আকৃতিতে নারীদেহে এই ‘ফাইব্রয়েড’ বেড়ে উঠে। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে অন্তত একজনের শরীরে এই অসুস্থতা দেখা যায়। শতাংশের বিচারে ২৫ শতাংশ নারীর দেহে ‘ফাইব্রয়েড’ থাকতে পারে। পনের-ষোল বছর বয়স থেকে শুরু করে পঞ্চাশ বছর বয়সী যে কোনো নারীর দেহে ‘ফাইব্রয়েড’ হতে পারে। তবে ২০ বছরের কম বয়সী মেয়েদের দেহে এর উপস্থিতি কম। ৩০-৪০ বছর বয়সীদের মধ্যেই ‘ফাইব্রয়েডে’ আক্রান্তের হার বেশি। দৈর্ঘ্যের দিক থেকে ফাইব্রয়েডের আকার এক মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। ওজনের দিক থেকে ১ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। মাঝেমধ্যেই চিকিৎসকগণ অপারেশন করে নারীদের জরায়ু থেকে ফুটবল আকৃতির ‘ফাইব্রয়েড’ টিউমার বের করে থাকেন।
কোথায় এবং কেন ফাইব্রয়েড সৃষ্টি হয়?

মূলত নারীদের জরায়ুতে ‘ফাইব্রয়েড’ হয়ে থাকে। তবে জরায়ুর পেশিতে ও অন্তঃত্বকে অনেক সময় ফ্যালোপিয়ান টিউবের মুখে, ব্রড লিগামেন্ট ও ডিম্বাশয়ের পাশেও ‘ফাইব্রয়েড’ সৃষ্টি হতে পারে। শতকরা ২০-৫০ শতাংশ নারীর দেহে এর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু কেন শরীরের অভ্যন্তরীণ একাধিক অঙ্গে এই ‘ফাইব্রয়েড’ সৃষ্টি হয় তার প্রকৃত কারণ এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা জানতে পারেননি। তবে ধারণা করা হয়, যৌনবতী নারীদের দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসরণের সঙ্গে এই ‘ফাইব্রয়েড’ সৃষ্টির কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। কারণ, নারীর দেহে যখন ইস্ট্রোজেন সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষরণ হয় সেই সময়, অর্থাৎ ২৫-৪০ বছর বয়সে ফাইব্রয়েড তৈরি হয়। আবার ‘মেনোপজ’ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ‘ফাইব্রয়েডের’ বৃদ্ধি থেমে যায়।

নারীরা কি করে বুঝবেন?

একটু গুরুত্ব দিয়ে লক্ষ্য করলেই যে কোনো নারী বুঝতে পারবেন তার শরীরে নীরবে এই মারাত্মক শত্রু হানা দিয়েছে। শরীরে এই অসুস্থতা সৃষ্টি হলেই নারীদের দেহে কতগুলো লক্ষণ ফুটে উঠে। আবার অনেক সময় মহিলাদের শরীরে এই অস্বাভাবিক অসুস্থতা নীরবে থাকায় রোগী বুঝতেই পারেন না। লক্ষণগুলো হল—

ক) ঋতুকালীন অতিরিক্ত রক্তস্রাব।

খ) নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাসে একবারের পরিবর্তে দশ-পনের দিন পর পর হঠাৎ করেই রক্তস্রাব।

গ) তলপেটে ভারী কিছু থাকার অনুভূতি।

ঘ) ঋতুস্রাবের সঙ্গে পেটে অস্বাভাবিক ব্যথা।

কি কি ক্ষতি হয়?

মহিলাদের স্বাভাবিক মা হওয়ার পথে ‘ফাইব্রয়েড’ অনেকটাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এগুলো হল—

ক) সবসময় শরীরে একটা অস্বস্তির অনুভব হয়।

খ) জরায়ুর অন্তঃত্বকে হলে অকাল গর্ভপাত হয়।

গ) জরায়ুর ভিতরে হলে রক্তস্রাবে সমস্যা হয়।

ঘ) জরায়ুর মাংসপেশিতে হলে ঋতুকালীন পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।

ঙ) কোষ্ঠকাঠিন্য ও রক্ত স্বল্পতা (এ্যানিমিয়া)।

চ) স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব, সাময়িক বন্ধ্যাত্বও হতে পারে।

ছ) অনেকের ক্ষেত্রে মূত্রথলিতে সংক্রমণও হয়।

তবে কখনো কখনো কোথায় ‘ফাইব্রয়েড’ হয়েছে তার ওপর অসুস্থতা নির্ভর করে।

ফাইব্রয়েড হলে চিকিৎসা কি হবে?

অনেক নারীর শরীরে ফাইব্রয়েড থাকলেও সারাজীবন তেমন কোনো সমস্যা অনুভূত না হওয়ায় চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হয় না। আবার অনেকে এক বা দু’টি সন্তান জন্মের পর এই সমস্যায় ভোগেন বলে খুব একটা গুরুত্ব দেন না।

কোন বয়সে বা কি অবস্থায় আছেন রোগী তার ওপরেই চিকিৎসার বিষয়টি নির্ভর করে। কারণ, চিকিৎসার তিনটি পদ্ধতি আছে—

২ক) কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট : এই ধারায় কোনোরকম চিকিৎসা না করে ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া। এবং মেনোপজ পর্যন্ত অপেক্ষা করা। তবে এই সময় নষ্ট করলে ভবিষ্যতে অন্য অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।

খ) মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখিয়ে তাদের পরামর্শ মেনে ওষুধ ও ইঞ্জেকশন ব্যবহার করা। প্রয়োজনে হরমোন থেরাপি দিয়ে ‘ফাইব্রয়েড’ শুকিয়ে দেওয়া। বিশেষ করে যারা মা হতে চান তাদের জন্য এই চিকিৎসা-ধারা অনেক বেশি পজিটিভ।

গ) সার্জিকেল ম্যানেজমেন্ট : অপারেশন করে ফাইব্রয়েড জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের গায়ে যেখানেই হোক তা সরিয়ে দেওয়া। এই ধারার তিনটি মুখ্য পদ্ধতি আছে।

প্রথম পদ্ধতি, মায়োমেক্টমি অর্থাৎ ফাইব্রয়েড নামের টিউমারটি পুরোপুরি বাদ দেওয়া। এই বাদ দেওয়ার পদ্ধতিটিও তিন ধরনের।

(১) ল্যাপারোস্কোপি : এই অপারেশনে রোগীর পেটে শুধুমাত্র দু’টি বা তিনটি ছোট করে গোটা অপারেশনটি করা হয়। রক্তপাত ও যন্ত্রণা কম, চটজলদি কাজে ফিরতে পারেন মহিলারা।

(২) হিস্টেরোস্কোপি : জরায়ুতে হিস্টেরোস্কোপ যন্ত্রের ক্যামেরা ঢুকিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়।

(৩) ল্যাপারোটমি : এটি এক ধরনের ওপেন সার্জারি। সরাসরি পেট কেটেই ফাইব্রয়েড বাদ দেওয়া হয়।

দ্বিতীয় পদ্ধতি, এম্বোলাইজেশন : এই ধারায় ফাইব্রয়েডে রক্ত সরবরাহকারী সমস্ত ধমনীগুলো বন্ধ করে দিলে তা আপনা-আপনি শুকিয়ে যায়। ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়। যেহেতু কাটা-ছেঁড়া করার প্রশ্ন নেই, তাই এই পদ্ধতিটি অনেক বেশি নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন।

তৃতীয় পদ্ধতি, হিস্টেরেকটোমি : এই পদ্ধতিতে টিউমার অর্থাৎ ফাইব্রয়েডসহ গোটা জরায়ুটি অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয়। মূলত যারা মা হয়ে গিয়েছেন অর্থাৎ আর সন্তান নেওয়ার প্রশ্ন নেই, তাদের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়।

[সংগৃহীত]



মন্তব্য চালু নেই