নারীদের মনোজগতে শুধুই ভারতীয় সিরিয়াল!
টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় গত ২২শে ডিসেম্বর ঘটে গেল মর্মান্তিক এক ঘটনা। এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে আরেক নারী। কারণ ভারতীয় সিরিয়াল। কোনো গল্প নয়, একেবারেই সত্যি ঘটনা। ভারতীয় সিরিয়াল দেখাকে কেন্দ্র করে ২২ বছরের সুমি আক্তারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে একই বাসার ভাড়াটিয়া রিনা বেগম।
কলেজপাড়ার ছয় নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল হক শামীমের বাসায় এ ঘটনা ঘটে। টাঙ্গাইল থানার পুলিশের কাছ থেকে জানা গেছে, ২২শে ডিসেম্বর বিকালে কাউন্সিলর শামীমের বাসার ভাড়াটিয়া শাহাজাদির ঘরে টিভি দেখতে যায় পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া সুমি আক্তার ও রিনা বেগম। এ সময় দু’জনের মধ্যে ভারতীয় সিরিয়াল দেখা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এরই এক পর্যায়ে সুমিকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন রিনা। পরে আহত সুমিকে স্থানীয় জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় রিনা বেগমকে আটক করে পুলিশ। বাংলাদেশের একটি জেলা শহরের চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনা স্থান পেয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল- ইউনিসেফ’র সাম্প্রতিক এক ফিচার প্রতিবেদনে। এর ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাসস। সেখানে বলা হয়েছে, আধুনিক এই যুগে টেলিভিশনে স্যাটেলাইট সংযুক্ত থাকায় পুরো বিশ্বই এক বাক্সে বন্দি বলা চলে। এখন মানুষ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেল দেখার সুযোগ পাচ্ছে। আর এর মধ্যে কোনো কোনো দেশের কিছু অনুষ্ঠান এমন আসক্তি তৈরি করেছে দর্শকদের মনে, যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে।
প্রভাবগুলো বিশ্লেষণে দেখা গেছে বেশির ভাগই নেতিবাচক! এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভারতীয় সিরিয়ালগুলো (ডেইলি সোপ)। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে (যে কোনো সামাজিক অবস্থান হোক না কেন) বাড়ছে ভারতীয় সিরিয়াল দেখার আসক্তি। বিশেষ করে এ নেশায় জড়িয়ে পড়ছেন নারীরা। আর তাদের সঙ্গে থাকা শিশুরাও অনেক ক্ষেত্রে এসব সিরিয়ালের ভক্ত হয়ে উঠছে! স্টার জলসা, স্টার প্লাস, জি বাংলা, জি টিভি, সনি এসব চ্যানেল যেন এখন রমণীদের কাছে নিত্যদিনের কাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রান্না কিংবা খাওয়া হোক বা না হোক, এসব চ্যানেলে অনুষ্ঠিত নাটক তাদের দেখা চাই-ই চাই। এই নাটকগুলোর প্রভাব এমন পড়ে যে, আশেপাশে একটু তাকালেই তাস্পষ্ট হয়ে যায়।
ঈদ, নববর্ষ কিংবা যে কোনো উৎসবকে সামনে রেখে চলে এসব সিরিয়ালের নায়িকা কিংবা আকর্ষণীয় কোনো নারীর নাম অনুসারে পোশাক বিক্রির হিড়িক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নজর দিলেই বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে উঠবে সবার সামনে। ভারতীয় এক সিরিয়ালের নায়িকা পাখির নামকরণে পাখি থ্রি-পিস কিনে না দেয়াতে আত্মহত্যা করেছে বাংলাদেশের কিশোরী। এই পোশাক কিনে না দেয়ায় স্বামীকে তালাক দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এর প্রভাব ছেলেদের মধ্যেও কম নয়। সম্প্রতি ছেলেকে পড়তে বসিয়ে বাবা-মা সিরিয়াল দেখতে বসে। এ অবস্থায় তাদের ৭ বছরের ছেলে সিরিয়াল দেখার সুযোগ না পেয়ে করেছে আত্মহত্যা। তারপরও দিব্যি চলছে এসব চ্যানেল। শুধু এমনটাই নয়, আরো অনেকভাবে এই সিরিয়ালগুলো অপরাধের পরোক্ষ মদত দিচ্ছে।
প্রতিটা সিরিয়ালেরই বিষয়বস্তু পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস, নারী-পুরুষের অবাধ মিলন, তুচ্ছ কারণে খুন, নির্যাতন, পরচর্চা ইত্যাদি। আর এসব দেখে দেখে আমাদের নারী ও পুরুষরাও অনুকরণ করছে। একটা সংসার কিভাবে নষ্ট করা যায় তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব উপায়ই সিরিয়ালগুলোতে দেয়া আছে। আর অনেক নারী-পুরুষ সেগুলো গোগ্রাসে গিলছে। অনেকে বলছেন, আমাদের মিডিয়া ভালো কিছু দিতে পারছে না বলে এইসব ভারতীয় সিরিয়ালের আসক্তি কাটছে না। কিন্তু মনে রাখা জরুরি যেকোনো মন্দ জিনিসেই আসক্তি বা নেশা হয়। ভালো বিষয়ে হয় না। এদিকে, ভারতীয় এসব চ্যানেলের কারণে আজ হুমকির মুখে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো।
ভারতীয় চ্যানেলের ভিড়ে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলো এখন নিজেদের হারিয়ে খোঁজার উপক্রম। সেই সঙ্গে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি আজ হুমকির মুখে। বাঙালির অনেক উৎসবে নারীকে এখন আর দেখা যায় না চিরচেনা বাঙালির রূপে। না পোশাকে, না সাজ-সজ্জায়। সবাই ভারতীয় অমুক সিরিয়ালের কায়দায় সাজবে, তাদের এই অনুষ্ঠান বা ওই অনুষ্ঠানের অনুকরণে আনুষ্ঠানিকতাও করবে। এমনকি এখন বিয়ের আয়োজনেও বর-কনের আগ্রহে কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের আগ্রহে বিয়ের সাজ-সজ্জা থেকে শুরু করে সেট ডিজাইনও হয় ভারতীয় সংস্কৃতির আদলে। বিয়ের রীতিতেও আধুনিকতার নামে ঢুকে যাচ্ছে ভারতীয় রীতি।
এসব চ্যানেলের চাকচিক্য, খোলামেলা আর আভিজাত্যের দর্শনে বাঙালির মাঝে একধরনের বিলাসিতার বাসনা সৃষ্টি করেছে। দামি পোশাক সাধারণ পরিবারগুলো কিনতে না পারার কারণে তৈরি হচ্ছে অসহিষ্ণুতা আর ঘটছে নিত্য নতুন অপরাধ। আর সব মিলিয়ে বর্তমানের অস্থিরতার জন্যও দায়ী এসব সিরিয়াল। শুধু সংসার আর অপরাধের মধ্যেই এখন আর সীমাবদ্ধ নেই এসব সিরিয়াল। বাচ্চাদের পড়ার বইয়েও রয়েছে এসব সিরিয়ালের কাহিনী। লেখার খাতার উপরেও রয়েছে এসব সিরিয়ালের নায়ক বা নায়িকাদের ছবি। পেন্সিলেও থাকে ভারতীয় সব কার্টুন ছবির স্টিকার।
মনোবিজ্ঞানী ও সংস্কৃতিসেবীদের উৎকণ্ঠা: মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যেহেতু বাংলাদেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক নারীই এখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিভি সেটের সামনে রিমোট হাতে বসে ভারতীয় হিন্দি, বাংলা সিরিয়াল দেখতে থাকেন, তাই একই বিষয় বারবার দেখতে দেখতে তাদের মনোজগতে বিষয়গুলো এমনভাবে গেঁথে যায় যে, তারা নিজেদের অজান্তেই অর্থাৎ নারীদের অবচেতন মনেই বিষয়গুলো নিজ দায়িত্বে জায়গা করে নেয়। এবং তারা এগুলোকে যাপিত জীবনে ব্যবহার করে (যদিও খুব একটা সচেতন জায়গা থেকে নয়)। সংস্কৃতিসেবীরা এই বিষয়টিকে দেখছেন মহামারি আকারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, কোনো প্রতিষেধকই এখন আর কাজ করছে না।
অভিজাত শ্রেণি থেকে শুরু করে একেবারেই পতিত শ্রেণি, উচ্চবিত্ত থেকে নিন্মবিত্ত পরিবার, বয়স্ক থেকে শিশু পর্যন্ত সবাই এই মহাব্যাধিতে নিমজ্জিত। আমাদের বাচ্চারা এখন মায়ের ভাষা বাংলা শিখার আগেই হিন্দিতে কথা বলা রপ্ত করে ফেলছে। আর এটি হচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কারণে। এখনকার নারীদের আড্ডা কিংবা বৈঠকের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে অমুক চ্যানেলে অমুক সিরিয়ালের আলাপন। স্টার প্লাস, স্টার জলসা, জি বাংলাসহ একাধিক চ্যানেল রয়েছে, যেগুলোর মোহে মজেছে আমাদের দেশের নারী সমাজ।
ভারতীয় সিরিয়ালের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে থাকে বৌ-শাশুড়ি, কিংবা ননদ-ভাবি অথবা জা-জায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, চুলোচুলি আর প্যাঁচ লাগিয়ে একে অপরের ঘর ভাঙা কিংবা পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যেটি, সেটি হলো এসব সিরিয়ালে, দৃষ্টিকটূ বেশ-ভূষা, পরকীয়া আর অবৈধ সম্পর্কগুলো থাকে অতি সাধারণ বিষয়। আর এসব দেখে তারাও ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিপরীত ধারায়।
শেষ কথা: বিশ্বায়নের এই যুগে নিজেকে গুটিয়ে রাখা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি অন্যদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ারও সুযোগ নেই। তাই নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে ভালোবেসে, অন্যের ভালোটা নিয়ে যদি আমরা সমৃদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করি তাহলে হয়তো ভারতীয় সিরিয়ালগুলোকে আর দোষারোপ করতে হবে না। তাই নারীদের যার যার অবস্থান থেকে দীঘর্মেয়াদি ক্ষতিকর মানসিকতার ভারতীয় নাটক পরিহার করে দেশীয় সংস্কৃতির লালন ও বিকাশে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এমজমিন
মন্তব্য চালু নেই