“নারকেল, কাঁঠাল বিক্রি করেছি কিন্তু পড়ালেখা থামাইনি”

বাংলাদেশের কৃতী পদার্থবিজ্ঞানী দীপঙ্কর তালুকদার। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় যুক্ত আছেন। লাইগো নামে সুবিশাল এক যন্ত্রের সাহায্যে গত বছর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেছিলেন একদল বিজ্ঞানী, সাড়া পড়ে গিয়েছিল পুরো বিশ্বে। সেই বিজ্ঞানী দলের একজন ছিলেন দীপঙ্কর তালুকদার। ২১ সেপ্টেম্বর এক জাতীয় দৈনিকের কার্যালয়ে বসে তিনি বলছিলেন, কেমন করে বরগুনার স্কুল থেকে তাঁর স্বপ্ন পৌঁছে গেল মহাকাশ অবধি।

সব ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম ছোট। ঢাকায় বাবার বেশ বড় ব্যবসা ছিল। একসময় আমরা ঢাকা থেকে বরগুনা চলে গেলাম। ওখানে আমার দাদুরাও বেশ অবস্থাপন্ন ছিলেন। বাবার আর্থিক অবস্থার অবনতি হলো দুটো কারণে। প্রথমত, বাবা দুই হাত খুলে মানুষজনকে দান করতেন, গরিবদের সাহায্য করতেন, আবার নিজের জীবনটা উপভোগ করতেও খরচে কার্পণ্য করতেন না। দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালে বাবা তাঁর সম্পদের প্রায় সবটুকুই হারালেন। ওখান থেকে তিনি আর ফিরে আসতে পারেননি। আমি যখন পড়ালেখা শুরু করি, তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। আত্মীয়রা বলত, তুমি যেখানে আছো, এই অবস্থান থেকে জীবনে কিছুই করতে পারবে না। কাছের আত্মীয়রাও কটাক্ষ করত। আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু বুঝতাম। কিছু বলতাম না। ওভাবেই জীবনের শুরু।

কিন্তু মনে মনে একটা কথা সব সময় ভাবতাম। যেটা আমি এখনো সবাইকে বলি। সেটা হলো, ওরা যেভাবে চাইছে আমি যদি সেভাবেই এগোই, তাহলে আমার অবস্থাটা কোথায় যাবে। আর আমি যদি তাঁদের কথার উল্টো দিকে যাই, তাহলে কত দূর যেতে পারব? ভেবে দেখলাম, ওরা যা চাইছে, আমাকে ঠিক ওটার উল্টোটা করতে হবে।

তাই পড়ালেখা ছেড়ে দিইনি। নারকেল বিক্রি করেছি, কাঁঠাল বিক্রি করেছি, তবু পড়ালেখা থামাইনি। মা খুব শক্ত মহিলা ছিলেন, পড়ালেখার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতেন না। বরগুনা স্কুল, বরগুনা কলেজে পড়েছি। কলেজে শিক্ষকদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। কারণ, আমি গণিত খুব পছন্দ করতাম। যেকোনো গাণিতিক সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান করতে পারতাম, যেটা স্যারদের বিস্মিত করেছিল।

বরগুনা কলেজ থেকে পাস করার পর আমার শিক্ষকেরাই আমাকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। আত্মীয়স্বজনদের দিক থেকে নানা বাধা ছিল। আমাদের আর্থিক অবস্থা তখনো খুব একটা ফেরেনি। আমার ভাই তখন ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করেছেন। আমার ইচ্ছা ছিল বৃত্তি নিয়ে জাপানে যাব। অনেক টাকাও দিয়েছি এর পেছনে। বেশ কয়েকটা পরীক্ষা দিয়েছি। সব ধাপ পেরিয়ে শেষে মন্ত্রণালয়ে গিয়ে আটকে গেলাম। আমার কোনো ‘ব্যাকআপ’ ছিল না। তো যা হয় আর কী…আমাকে বলা হলো, ‘আপনি কোয়ালিফায়েড না।’

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। তবে আমার ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ব। হয়তো আমার যোগ্যতা ছিল না। আরেকটা ব্যাপার হলো, ভর্তির জন্য যে কোচিং করতে হতো, সেই কোচিং করার সামর্থ্য ছিল না। বরগুনা থেকে ঢাকায় এসে কারও সঙ্গে মেসে থেকে কোচিং করা, এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। তখন ভাবতেও পারতাম না।

তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, তখন খোরশেদ আহমেদ কবীর স্যার আমাদের কোয়ান্টাম মেকানিকস পড়াতেন। অনেকেই তাঁকে চেনেন। আমার জীবনের সেরা শিক্ষক। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কোর্স করেছি, কেমব্রিজেও পড়েছি, কিন্তু তাঁর মতো করে এত ভালো কোয়ান্টাম মেকানিকস কাউকে পড়াতে দেখিনি। তিনিই মূলত আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন।

কেমব্রিজ থেকে ওখানে স্নাতকোত্তর করার অফার পেলাম। কিন্তু তখন বাবা অসুস্থ ছিলেন। পারিবারিক নানা সমস্যা ছিল। অনেক টাকার দরকার ছিল। সরকারের কাছে বৃত্তির আবেদনও করিনি। কারণ, আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম আমি পাব না। তো স্যারকে বললাম, স্যার কী করব? তিনি বললেন যে ইংল্যান্ডের সরকার কলেজের মাধ্যমে একটা বৃত্তি দেয়, তুমি ওটার জন্য অ্যাপ্লাই করো।

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলাম। স্নাতকোত্তর শেষ করে ওখানেই পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পড়তে চাইনি। কারণ, যে বিষয়ে পড়েছিলাম সেটা বেশ ‘থিওরেটিক্যাল’ ছিল। আমার ইচ্ছা ছিল অন্য কোথাও অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আরও পড়ব। তাই দেশে ফিরে এলাম। ফিরেই মাস্টারমাইন্ড স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। কারণ, যেদিন ফিরে আসি, আমার কাছে ছিল এক হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড। ঢাকায় থেকে টোয়েফল, জিআরই করার জন্য ওই টাকাটা যথেষ্ট ছিল না। মাস্টারমাইন্ডে বেশ ভালোই চলছিল। পরে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলেও পড়িয়েছি।

একটা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার পেলাম। তখন আবেদন করার মতো যথেষ্ট টাকাও ছিল। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব ঠিক করতে পারছিলাম না। তো আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক, কবীর স্যারের কাছে গেলাম। প্রথম দিন তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি বিদেশে যাবে কেন? তুমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এত টাকা আয় করছ, বিদেশে গিয়ে কী করবা?’ দ্বিধায় পড়ে গেলাম।

পরের দিন আবার তাঁর কাছে গেলাম। বললাম, স্যার, আপনি তো বললেন দেশেই থাকতে…তিনি রীতিমতো ধমক দিলেন, ‘তুমি দেশে থাকবে কেন? তোমার আরও পড়ার যোগ্যতা আছে, তুমি বিদেশে যাবে।’ (হাসি)

আমি আরও দ্বিধায় পড়ে গেলাম। স্যার আসলে একটু এমনই ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি একটা ভালো পরামর্শ দিলেন। বললেন, নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজো না। যদি কোনো পরিচিত শিক্ষক তোমাকে নিতে চান, তুমি তাঁর কাছে যাও। আমি যেখানে পিএইচডি করেছি, ওখানে প্রফেসর আমাকে কল করেছিলেন। লাইগোর প্রজেক্ট তিনিই আমাকে বুঝিয়েছিলেন। সেই স্যারকে বললাম। তিনি বললেন, আমি খুবই আগ্রহী তোমাকে নিতে। কবীর স্যারও খুব উৎসাহ দিলেন। স্যারের পরামর্শেই সিদ্ধান্ত নিলাম।

২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি। আমি মনে করি, সেখানে আমি তুলনামূলক কম সময়ে পিএইচডি শেষ করতে পেরেছি। কারণ, পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করতে আট থেকে দশ বছরও লেগে যায়। ছয় বছরের পিএইচডির দ্বিতীয় বছরে জার্মানি থেকে প্রস্তাব পেলাম, আমি সেখানে এক বছর কাজ করতে পারব। জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট, হ্যানোভারে এক বছর কাজ করে ফিরে এসে আমার তৃতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করলাম।

তখন চাকরি খোঁজার পালা। দুটো পথ ছিল—ইন্ডাস্ট্রি অথবা একাডেমি। আমি একাডেমি বেছে নিলাম। কারণ, জানতাম লাইগো একদিন সফল হবে। আর চ্যালেঞ্জ না নিলে তো বড় কিছু করা যায় না, তাই না?

সেই থেকে লাইগোর সঙ্গেই আছি। অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি। কারণ, তাঁরা আমাকে খুব বেশি পছন্দ করে। আমার পুরো জীবনটাই খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। একটু ভুল সিদ্ধান্ত নিলেই আমি হয়তো পা পিছলে পড়ে যেতাম।খবর প্রথম আলো’র।



মন্তব্য চালু নেই