নানা সংকটে দিনে দিনে কমে আসছে কুড়িগ্রামের পাটনি সম্প্রদায়ের পরিসর

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: একসময় নদীতে খেয়া ঘাটে মানুষ পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করত কুড়িগ্রামের পাটনি সম্প্রদায়। কিন্তু কালের পরিবর্তনে খেয়া ঘাটগুলো সরকারীভাবে ইজারা পদ্ধতি চালু হওয়ায় দিনে দিনে এ পেশা হারাতে হয়েছে তাদের। এখন অনেকের বাস্তুভিাটাটুকুও নেই। নেই তাদের শবদেহ সৎকারের জায়গাটুকুও। রাস্তার পাশে খাস জমিতে বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করে জীবন যুদ্ধে কোন রকমে টিকে আছে দলিত সম্প্রদায়ের এ মানুষগুলো।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঠালবাড়ী ইউনিয়নে কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের পাশে বসবাস করছে অর্ধ শতাধিক পাটনি পরিবার। বাপ দাদার পেশা হারিয়ে বাঁশ ও বেতের তৈরী ডালি, কুলা, ডুলি, চালনিসহ বিভিন্ন গৃহস্থালী আসবাবপত্র তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। বর্তমানে প্লাষ্টিক সামগ্রীর দাপটে চাহিদা কমে আসছে তাদের তৈরী পন্যের। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে কোন রকমে চলছে তাদের সংসার। এ অবস্থায় নতুন করে সংকট তৈরী হয়েছে মৃত্যুর পর লাশের সৎকার নিয়ে। এতদিন অন্যের জমিতে লাশের সৎকারের ব্যবস্থা থাকলেও এখন আর সেই সুযোগটিও নেই। লাশ নিয়ে নামতে হচ্ছে রাস্তায়। ফলে এ সম্প্রদায়ের মানুষের চাওয়া জীবনের শেষ ঠিকানার জন্য একটু নির্দিষ্ট জায়গা।
সদর উপজেলার কাঠালবাড়ী ইউনিয়নের বাজার সংলগ্ন পাটনি সম্প্রদায়ের শ্রী রমেশ চন্দ্র অধিকারী বলেন, ২০ বছর আগে কাঠালবাড়ীতে পাটনি সম্প্রদায়ের আলাদা গ্রাম ছিল। সেখানে প্রায় ৪ শতাধিক লোকের বসবাস ছিল। তখন নদীর ঘাটে ইজারা হতো না। বাপ-দাদারা নদীর খেয়া ঘাটে নৌকা দিয়ে লোকপাড়া পাড়ের কাজ করে টাকা উপার্জন করে সংসার চালাতো। কিন্তু এখন তাদের সে পেশা কেড়ে নিয়েছে বিত্তবানরা। অন্য জাতের মানুষরা নৌকা দিয়ে লোক পাড়াপাড় করাচ্ছে। প্রতিযোগিতার যুগে মুল পেশায় টিকে থাকতে না পারায় পেশা বদলাতে হয়েছে তাদের। পেশা বদলিয়েও যান্ত্রিক যুগের সাথে তাল মেলোতে না পেরে পেশা ছেড়ে দিয়েছে অনেকেই।

পাটনি সম্প্রদায়ের গণেশ জানায়, এখন তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। নিজেদের থাকার জায়গা নেই। পাশাপাশি তাদের সম্প্রদায়ের কারো মৃত্যু হলে লাশ সদকারের জায়গা পাওয়া যায় না। আগের শ্বশান ঘাট ও কবরস্থান কলেজ তৈরি হয়েছে। মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি ঘরের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এজন্য এখন আর কেউ আমাদের লাশ পোড়ানো বা কবর দেয়ার জায়গা দেয় না। গত ২২ নভেম্বর আমার দাদী মারা গেলে তাকে পোড়ানো বা কবর দেয়ার জায়গা পাই নাই। ফলে আমাদের সম্প্রদায়ের সকলে মিলে লাশ নিয়ে রাস্তা অবরোধ করতে হয়েছে। পরে পুলিশ ও চেয়ারম্যান এসে লাশ পোড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন আমরা সরকারের নিকট মৃত্যুর পর শেষ ঠিকানা টুকু দাবী করছি। সরকার যেন একটু শ্বশান বা কবর স্থানের জায়গা করে দেয়।

একই পাড়ার করেন জানান, খেয়া ঘাটের ইজারা পদ্ধতি বিত্তবানদের হাতে চলে যাওয়ায় তাদের আদি পেশা মাঝি-মাল্লার কাজ ছেড়ে দিয়ে বউ বাচ্চা মিলে বাঁশ বেতের গৃহস্থালী পন্য তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা। কিন্তু এ পেশাও ভালো চলছে না তাদের। বউ বাচ্চা নিয়ে অতি কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।

পাটনি পাড়ার বিশ্বকা রানী ও শরস্বতী জানায়, জীবন-জীবিকায় নানা কষ্ট থাকলেও এ কষ্ট মেনে নিয়ে মৃত্যু পরবর্তী সৎকারের একটু জায়গাই এখন একমাত্র কাম্য আমাদের। আমরা তো এদেশেরই নাগরিক। আমাদের মৃত্যুর পর শান্তিতে ঘুমানোর জায়গা টুকুর ব্যবস্থা যেন সরকার করে দেয়। আমাদের লাশের সদকারের জন্য যেন আর রাস্তায় নামতে না হয়।

কাঠালবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন মঞ্জু জানান, পাটনি সম্প্রদায়ের মানুষের মৃতদেহ সৎকারের নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। গত ২২ নভেম্বর পাটনি সম্প্রদায়ের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হলে সদকারের জায়গা না পেয়ে তারা লাশ নিয়ে সড়ক অবরোধ করেছিল। পরে তাদের লাশ সদকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে তাদের একটি স্থায়ী শ্বশানের ব্যবস্থা করে দিবো।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়গুলোর পেশায় পৃষ্ঠপোষকতা, মৃত্যুর পর সৎকারের নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা করাসহ সম্প্রদায়গুলোকে টিকিয়ে রাখতে সকল ধরনের ব্যবস্থা নেবে সরকার এমনটাই প্রত্যাশা এ সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর।



মন্তব্য চালু নেই