দ্বন্দ্বে জর্জরিত জাপার অভিভাবক এখন প্রধানমন্ত্রী

দ্বন্দ্বে জর্জরিত জাতীয় পার্টি এখন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দুই শিবিরে বিভক্ত সংসদে প্রধান বিরোধী দলের অভিভাবক এখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী!

উপেক্ষিত এরশাদের অনুসারী শিবির এবং রওশনের নেতৃত্বে সুবিধাভোগী অপর শিবির বারবার নালিশ নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে যাচ্ছেন। স্বয়ং এরশাদও গেছেন।

সর্বশেষ সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার পদকে ঘিরে দুই মেরুতে অবস্থান করছেন এরশাদ ও তার পত্নী রওশন। এর জেরে দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য ইতিমধ্যে পদ হারিয়েছেন। অবাধ্য আরো অনেককে নাকি এরশাদ এই তালিকাভুক্ত করেছেন। যথাসময়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।

দ্বন্দ্বটা ক্ষমতার এবং সরকারে থেকে সুবিধা ভোগ করার প্রতিযোগিতার জেরে হলেও এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ- এমনটাই অনুমান করছেন অনেকে। অভিযোগটি জাপার ভেতর থেকেও উঠছে।

প্রথমত নির্বাচনের বিরোধিতা করে পরে আবার সরকারে অংশ নিয়ে কোণঠাসা এরশাদ। এছাড়া তার প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য দেখিয়ে যারা নির্বাচন বর্জন করেছিলেন তারা আজ বঞ্চিত। এই বঞ্চিতদের তালিকায় স্বয়ং এরশাদের ভাই জিএম কাদেরও রয়েছেন। সুতরাং সেদিক একটা চাপ সব সময়ই রয়েছে।

অপরদিকে সেসময় রওশনের নেতৃত্বেই আজকের সুবিধাভোগীরা একত্রিত হয়েছিলেন। তাই তারা তার নেতৃত্বেই জোটবদ্ধ। বিরোধীদলীয় নেতার পদটিও এরশাদকে এড়িয়ে রওশনকে দেয়া হয়েছে। বঞ্চিত নেতাদের চাপে অস্থির এরশাদের কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না তারা।

এই অবস্থায় ‘খাঁটি বিরোধীদল’ হওয়ার নয়া খায়েস জাগা জাপায় দ্বন্দ্ব-বিভক্তি জিইয়ে রেখে দলটিকে দুর্বল করে অনুগত রাখাই আওয়ামী লীগ মোক্ষম কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে এ কারণে জাপায় আরও এক দফা ‘ভাঙন’ ধরতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জাপার একাধিক শীর্ষ নেতা এমন আশঙ্কায়ই করছেন।

দলীয় সূত্র ও জাপার সংসদ সদস্যরা জানান, নির্বাচনকে ঘিরে যে নাটক তৈরি হয়েছিল ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার পর তার এক পর্বের যবনিকা পাত হলেও বিরোধীদলীয় উপনেতার পদকে ঘিরে নতুন পর্বে নাটকের কাহিনী ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে।

জানা যায়, রওশন বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার পরেই পদটি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এরশাদ। এরপর দলের চিফ হুইপ নির্বাচন, মহাসচিব পরিবর্তনসহ বিভিন্ন পদে নিজের ‘অনুগতদের’ স্থান দেয়ার চেষ্টা চলতেই থাকে। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে জাপার বিভক্তি।

সর্বশেষ অনুগতদের সঙ্গে নিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদকে দলের উপনেতা বানানোর সিদ্ধান্তে রওশনের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন এরশাদ। এ নিয়ে স্পিকারকে পাল্টাপাল্টি চিঠি দিয়েছেন তারা। বিষয়টি গড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত।

এখানেই শেষ নয়। এর একদিন পরেই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা ও চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। একইসঙ্গে রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। অবশ্য গণমাধ্যমে খবর পেলেও এ বিষয়ে তারা কোনো চিঠি পাননি বলে জানান।

এদিকে অব্যাহতির এ ঘটনাকে বিএনপির ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছেন এক সময়কার বিএনপি নেতা তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এর পেছনে বিএনপির ষড়যন্ত্র থাকতে পারে’। রওশন শিবিরে ভিড় জমানো প্রকাশ্যে এরশাদের সমালোচনাকারী আরও দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য ‘অব্যাহতির’ তালিকায় আছেন বলেও দলীয় সূত্র জানায়।

তাজুল আরও বলেন, ‘এরশাদ তো বিরোধীদলের নেতা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এরশাদ আমাকে কয়েকবার বলেছেন, বিরোধীদলের দুই নম্বর চেয়ারে বসতে আমার ভালো লাগে না। তোমরা কিছু একটা কর। কিন্তু আমি এরশাদের এই অন্যায় আবদার প্রশ্রয় দেইনি। কেননা, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তো আমরা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে অংশ নিয়েছি। তখন তো এরশাদ নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন।’

প্রেসিডিয়ামের সদস্যপদ হারিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নালিশ জানিয়েছেন তাজুল ইসলাম চৌধুরী ও মশিউর রহমান রাঙ্গা। মাগরিবের নামাজের বিরতির পর শেখ হাসিনা যখন অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হতে উঠে দাঁড়ান, তখন বিরোধী দলের সারি থেকে তার কাছে ছুটে যান এই দুই এমপি। পেছনে পেছনে যান দলের সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও। এসময় তারা দলীয় চেয়ারম্যানের এসব সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানান।

এর কিছুক্ষণ পরেই বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের সঙ্গে বৈঠক করেন রাঙ্গা ও তাজুলসহ বেশ কযেকজন এমপি। তারা এরশাদের এ ধরনের সিদ্ধান্তকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে অভিহিত করেন। তারা রওশনের কাছে অভিযোগ করেন- কিছু হলেই বহিষ্কার, অব্যাহতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। চেয়ারম্যান হলেই এমন করবেন এটা সহ্য করা হবে না।

তবে রওশন নিজের ‘অনুসারী’ এসব এমপিদের ‘মাথা ঠাণ্ডা’ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, রওশন তাদের বলেছেন, ‘একটু মাথা ঠাণ্ডা রাখ। এগুলো তোমাদের শাস্তি নয়। এগুলো মূলত আমার সাথে করা হচ্ছে।’

তবে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা গেছে। বৈঠক শেষে প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের কাছে জানতে চাইলে বাংলামেইলকে তিনি বলেন, ‘দুই জনকে প্রেসিডিয়াম পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া প্রসঙ্গে ম্যাডাম তাদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। তিনি তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বলেন- দু’একদিন পার হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এরশাদ রাগের মাথায় এসব করেছেন বলেই ফিরোজ রশীদ দাবি করেন।

অব্যাহতি পাওয়া প্রসঙ্গে রাঙ্গা বলেন, ‘আই এম নট আনহেপি। তবে দলের চেয়ারম্যান (এরশাদকে) হিসেবে আকস্মিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত সব সময় নেয়া সাজে না।’

কেন এমনটি হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রাঙ্গা বলেন, ‘রাজনৈতিক দলে বড় কোনো কর্মসূচি না থাকলে দলের অভ্যন্তরে এমনটি হয়। জাতীয় পার্টির এখন বড় কোনো কর্মসূচি নেই, তাই এমনটি হচ্ছে।’

তবে দল থেকে বহিষ্কারকেও ভয় পান না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গা। তিনি বলেন, ‘দল থেকে আমাকে বাদ দিলে আমি অন্য যে কোনো দলের মন্ত্রী হয়ে যেতে পারি। এমনকি নিজেও দল গঠন করতে পারি।’

জাপার একাধিক নেতার অভিযোগ, সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব জাপাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই কৌশলে জাপায় বিভাজন জিইয়ে রাখছে। সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই জাপায় চলছে নেতৃত্বের নানা মেরুকরণ। একাজে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর বিরুদ্ধে।

জাপার একজন প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, বিরোধীদলের উপনেতা নির্বাচন নিয়ে সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব রওশনকে যেমন সমর্থন দিচ্ছেন তেমনি অনেকে আবার এরশাদকেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। শীর্ষ এই নেতৃত্ব চান না কোনো ইস্যুতে এরশাদ ও রওশন এক কাতারে আসুক। বরং তাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টিতেই কাজ করে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ একটি অংশ।

এ প্রেসিডিয়াম সদস্য আরও জানান, আওয়ামী লীগের এসব শীর্ষ নেতা রওশনকে বলে, আপনি এগিয়ে যান। আপনি নির্বাচনে গেছেন। আপনি যা বলবেন তা-ই হবে।

অপরদিকে এরশাদকেও তারা বলেন, এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি। অতীতে কী হয়েছে ভুলে যান। আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন সরকার সেই সিদ্ধান্তই মেনে নেবে।

জাপার একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সরকারের সবুজ সংকেত পেলেই এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি থেকে বেরিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি গঠনে হাত দেবেন এরশাদ বিরোধী সংসদ সদস্যরা। এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন রওশন। এটা করতে গিয়ে জাপার নতুন কোনো কাউন্সিল হবে না। এরশাদকেও তারা বহিষ্কার করবেন না। যেভাবে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নাজিউর রহমান মঞ্জু অংশ থেকে বেরিয়ে ডা. এমএ মতিন নতুন বিজেপি গঠন করেছিলেন। তিনি বলেন, এভাবে জাপা গঠন করা হলে কোনো পক্ষকেই সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে না।

জাপা আবারও ভাঙতে যাচ্ছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এরশাদ নিজেই জাপাকে ছোট করে আনছেন। সময়ই বলে দিবে কী হবে। তবে কিছু হলে এর জন্য এরশাদ দায়ী থাকবেন।’

এ প্রসঙ্গে প্রেসিডিয়াম সদস্য এমএ হান্নান এমপি বলেন, ‘এমন কিছু হচ্ছে না। হুট করে কারোরই কোনো ডিসিশন নেয়া ঠিক হয়নি। তবে মনে রাখতে হবে, জাপা ভাঙলেও এরশাদই সব থাকবেন। এখানে বিকল্প কেউ দাঁড়ানোর সুযোগ পাবেন না। এর প্রমাণ আপনারা অতীতেও পেয়েছেন’।

এ বিষয়ে জাপার মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দাবি করেন, ‘জাতীয় পার্টিতে কোনো বিরোধ নেই। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ। এরশাদ সাহেব যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই পার্টির সিদ্ধান্ত। এখানে মতবিরোধের কোনো সুযোগ নেই। আবারো বলছি, জাপায় কোনো বিরোধ নেই।’



মন্তব্য চালু নেই