চাঁদাবাজি আর অনিয়মের আখড়া

দৌলতদিয়া–পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি সঙ্কট,

মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি স্বল্পতায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। এ রুটের ১০টি রো রো ফেরির মধ্যে ৪টিই অকেজো। কিন্তু মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, মাধবীলতা ফেরিটি পাটুরিয়া ঘাটে অলসভাবে বসে আছে। এটি সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয়। অপর একটি ফেরির সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখন এটি মেরামতের অপেক্ষায়। এটি সচল করতে এক কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া রো রো ফেরি কেরামত পুনর্বাসন, আমানত শাহ্, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এবং হামিদুর রহমানও ডকে পড়ে রয়েছে অকেজো হয়ে।
তার উপর আছে- নিত্যদিন চাঁদাবাজি, ট্রাক সিরিয়ালে অনিয়মসহ নানা অব্যবস্থাপনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই ১০টি রো-রো ফেরি সক্রিয় করা না গেলে যানবাহন পারাপার নিয়ে বিপদে পড়তে হবে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো ক্ষমতা থাকবে না। জনগুরুত্বপূর্ণ এ ঘাটে  যানবাহন ও মানুষ পারাপার দিন দিন বাড়লেও গত ১৫ বছরে ফেরির সংখ্যা বাড়ানো হয়নি। যানবাহন পারাপারে যেখানে প্রয়োজন ১৪টি রো রো ফেরি সেখানে রয়েছে মাত্র ৮টি। এর মধ্যে আবার একটি পুনর্বাসনে অপেক্ষায়, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান প্রায় ৪ বছর যাবৎ এবং হামিদুর রহমান নারায়ণগঞ্জ ডকে পড়ে আছে মেরামতের অপেক্ষায়।
১০টির মধ্যে সক্রিয় ৬টি ফেরি দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রতিদিন গড়ে ২২টি জেলার ৮৮০টি বাস, ১ হাজার ৫২০টি ট্রাক, ১২শ’ বিভিন্ন ক্যাটাগরির যানবাহন এবং প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পারাপার করা সম্ভব নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রো-রো ফেরির এক মাস্টার জানান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) বর্তমান ম্যানেজমেন্টের সময় যেসব ফেরি মেরামত করা হয়েছে তা খুবই নিম্নমানের। লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঠিক করে এনে পাটুরিয়ায় এসে দু’এক দিনের মধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বসে থাকে।
সূত্র জানায়, একটি ফেরি নারায়ণগঞ্জ যেতে ৩ লাখ টাকার জ্বালানি খরচ হয়। গত ৫ বছরে শুধু নারায়ণগঞ্জ যেতেই কয়েক কোটি টাকার জ্বালানি ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ ব্যয় দিয়ে একটি রো-রো ফেরি তৈরি করা সম্ভব হতো বলে ফেরির মাস্টাররা জানান।
বেপরোয়া চাঁদাবাজি: পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে চাঁদাবাজি করেন শ্রমিক নেতারা। পরিবহনের বুকিং কাউন্টার থেকে তারা লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলেন। বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন এই চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছে।
তাছাড়া সরজমিনে জানা গেছে, শ্রমিক নেতারা দৌলতদিয়া ঘাটে ট্রাক বুকিং কাউন্টার থেকে প্রতিদিন ৮ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করছেন। শুধু ট্রাকের কাউন্টার থেকেই তারা মাসে আদায় করছেন ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বাস কাউন্টার থেকে দিনে আদায় করছেন ২ হাজার টাকা। বাসের কাউন্টার থেকে প্রতি মাসে তারা চাঁদা তুলছেন ৬০ হাজার টাকা।
তিন শিফটের প্রতিটিতে বুকিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তারা মাসের প্রথম সপ্তাহে দিনে ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করেন। তিনটি শিফটে দিনে ৩০ হাজার টাকা হিসেবে মাসে চাঁদা আদায় করেন ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এছাড়াও ছোট ও বড় গাড়ির কাউন্টারে দায়িত্ব পালনের জন্য কর্মচারীদের প্রতিদিন দিতে হয় ১ হাজার টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা।
অন্যদিকে পাটুরিয়া ঘাট থেকে চাঁদা তোলা হয় মাসে ৬০ হাজার টাকা। সহকারী টার্মিনাল সুপারভাইজার রায়হান, মাজাহারুল ইসলাম এবং গোলাম মোস্তফা বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টার থেকে মহসিন ভুঁইয়ার নামে চাঁদা তোলেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক নেতা জানান, ফেরিঘাটের দুই পারে পণ্যবাহী ট্রাক টার্মিনালে অপেক্ষা করানো হতো। এবং মাইকিং করে সিরিয়াল অনুযায়ী গাড়িগুলো ফেরিতে ওঠানোর নিয়ম। কিন্তু স্থানীয় একটি দালাল চক্র ঘাটে কৃত্রিম যানজট তৈরি করার জন্য ট্রাকগুলোকে টার্মিনালে পার্ক না করে সরাসরি ফেরিঘাটে নিয়ে আসছে। এবং বাস ও ট্রাকগুলোকেও একই লাইনে রেখে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি করছে।
অভিযোগ রয়েছে, দালাল চক্র যানজট তৈরি করে পণ্যবাহী ট্রাক থেকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫শ’ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। আর যাত্রীবাহী যানবাহনকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয় না। আর এই চাঁদাবাজির কারণে ফেরি লোড-আনলোডে অযথাই সময় অপচয় হয়।
এই যানজটের জন্য অবশ্য অব্যবস্থাপনাও দায়ী। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিসির ডিজিএম ( আরিচা ঘাটের) সাহাদত আলী  জানান, অব্যবস্থায় চলছে দৌলতদিয়া ঘাট। যে ট্রাকগুলো মহাসড়কে রাখা রয়েছে তা রাখার নিয়ম নেই, ট্রাকগুলোকে ট্রামিনালে ঢোকানোর কথা কিন্তু এক শ্রেণীর দালালচক্র ট্রাকগুলোকে আগে পার করার জন্য মহাসড়কে রাখে।
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার সাবেক এজিএম নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী জানান, প্রতিনিয়ত যে যানজট লেগে থাকে এর কারণ পারাপারের ট্রাকগুলো টার্মিনালে না ঢোকা, আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে প্রসাশনের দুর্বলতা, লোকাল বাস ও ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীবাহী কোচগুলো টার্মিনাল দখল করে নিয়েছে। বাইপাস রাস্তা নেই।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা ফেরি সেক্টরে কর্মরত মো. আশরাফ উল্লাহ জানান, বর্তমানে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে একটি কে টাইপ ফেরিসহ মোট ৮টি ফেরি চলাচল করছে। মাঝে মধ্যে দুই একটি ফেরি স্থানীয় ভাসমান কারখানায় মেরামতের জন্য পাঠাতে হয়। বর্তমানে ফেরি পারাপারে কোনো সমস্যা নেই বলে জানান তিনি।
বিআইডব্লিউটিএর স্থানীয় এক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ফেরি চ্যানেলে ১০ থেকে ১১ ফুট পর্যন্ত পানির গভীরতা রয়েছে। একটি রো রো ফেরিকে ফুল লোড দিয়ে চলতে গেলে  সাড়ে ৬ ফুট থেকে ৭ ফুট পানি প্রয়োজন।



মন্তব্য চালু নেই