দেশ বিদ্যুতে ভেসে গেলেও আপাতত পিছু ছাড়ছে না লোডশেডিং !
প্রায় বছর দুই আগে বলেছিলাম, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ দেয়ার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বসে থাকবে, কিন্তু আমাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা তা নিতে পারব না। কারণ তা নেয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই। সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে না পারলে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোকে অলস বসে থাকতে হবে। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা থাকলেও শেডিং বন্ধ হবে না। এই প্রচণ্ড গরমের শুরুতে এখন তাই শোনা যাচ্ছে। প্রচুর উৎপাদন সত্বেও অনেক এলাকায় ঘন ঘন শেডিং হচ্ছে, জনগণ পড়েছে অস্বস্তিতে।
২৩০ এবং ১৩২ কেভি লাইন, গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ৩৩ কেভি হয়ে এলাকার ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশন পর্যন্ত বলা হয় সঞ্চালন লাইন বা সঞ্চালন ব্যবস্থা। এরপর ৩৩/১১ কেভি সাব-স্টেশন এবং সেখান থেকে এসটি লাইন দিয়ে রাস্তায় বসানো ১১ কেভি ট্রান্সফরমার হয়ে এলটি লাইন দিয়ে বাসাবাড়িতে যাওয়া পর্যন্ত সিস্টেমকে বলা হয় বিতরণ ব্যবস্থা। গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ৩৩ কেভি হয়ে বাসা বাড়ি পর্যন্ত এই অংশটুকুতেই বর্তমানে মারাত্মক সমস্যা বিদ্যমান। উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রার দিকে চলে গেছে, এখন আমাদের নজর দিতে হবে ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং সমগ্র বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়নে।
মনে করুন, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি। একটি এলাকার ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের মোট চাহিদা ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এই ২৪ মেও বিদ্যুৎ পেলে ঐ এলাকায় কোন শেডিং হবে না। এখন গ্রিড স্টেশন থেকে ৩৩ কেভি যে সঞ্চালন লাইনটি ঐ এলাকার ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের দিকে গেছে, সেই লাইন অনেক পুরাতন হওয়ায় তার বিদ্যুৎ ধারণ ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৪ মেগাওয়াট। মোট চাহিদা ২৪ মেও হওয়া স্বত্বেও ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনে এই ৩৩ কেভি লাইন দিয়ে ১৪ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ দেয়া যাবে না। তারমানে সেই এলাকায় ১৪ মেও বিদ্যুৎ লোড শেডিং করতে হবে।
যদি ঐ ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইন দিয়ে জোর করে তারের ধারণ ক্ষমতা ১৪ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়, তাহলে লাইন পুড়ে যাবে অথবা ক্যাবলের জয়েন্টগুলো গরম হয়ে লাল হয়ে যাবে, যাকে বলা হয় “রেডহট” কিংবা তা গলেও যেতে পারে। কাজেই এই এলাকায় শেডিং এড়াতে পুরাতন ৩৩ কেভি লাইন সরিয়ে ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পরিবহণে সক্ষম কিংবা তার চেয়ে উচ্চক্ষমতার লাইন স্থাপন করতে হবে।
এবার মনে করুন ঐ একই এলাকায় ২৪ মেও বিদ্যুৎ পরিবহণে সক্ষম ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইন আছে। কিন্তু ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের যে পাওয়ার ট্রান্সফরমার আছে তা ২০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ নিতে পারে না। সেক্ষেত্রে ২৪ মেও বিদ্যুৎ সরকার দিতে চাইলেও আপনি নিতে পারবেন না। পাওয়ার ট্রান্সফরমারের ধারণ ক্ষমতা ২০ মেও হওয়ায় সেখানে সর্বোচ্চ ১৬ মেও বিদ্যুৎ নেয়া যাবে। তারমানে ৮ মেও বিদ্যুৎ লোড শেডিং করতে হবে। এই ১৬ মেও এর চেয়ে বেশি বিদ্যুত নিতে গেলেই ট্রান্সফরমার ট্রিপ করে যাবে। পাওয়ার ট্রান্সফরমারের ক্ষমতা কম হওয়াকেই মূলত সিস্টেম ওভারলোড বলা হয়। এই কারণেই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ থাকার পরেও সবচেয়ে বেশি শেডিং দিতে হচ্ছে। এই পর্যায়ে শেডিং এড়াতে নতুন পাওয়ার ট্রান্সফরমার বসিয়ে সিস্টেমের ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
এই ধরনের শেডিংকে বলা হয় ফোর্স শেডিং। বিদ্যুৎ থাকা সত্বেও সিস্টেমকে ঠিক রাখতে জোর করে এই শেডিং দিতে হয়।
বিদ্যুৎ ওভারলোড কিংবা অন্য কোন কারণে ৩৩ কেভি লাইনের ইন্স্যুলেটর ক্র্যাক হলে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই ধরনের একটি ক্র্যাক খুঁজে বের করতে মাইলের পর মাইল, একটি একটি করে টাওয়ারে উঠে চেক করে ঐ সামান্য ক্র্যাক খুঁজে বের করে ঠিক করতে হয়। কোন কোন সময় এতে ঘণ্টার পর ঘন্টা ব্যয় হয়। রাস্তায় বসানো ১১ কেভি ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়ে পুড়ে গেলে তা বদলাতে অনেক সময় ২/৩ দিন সময় লেগে যেতে পারে। কখনও তার চেয়ে বেশি সময় লাগে।
১১ কেভি ট্রান্সফরমারের ত্রুটি প্রায় প্রতিদিনই লেগেই থাকে সব এলাকায়। ট্রান্সফরমার ওভারলোড, নিন্মমানের লুপ এবং ফিউজের তার ব্যবহারের কারণে তা পুড়ে গেলে বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রতি এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩/৪ টি ট্রান্সফরমারের ফিউজ লুপ পুড়ে যায়। একবার লুপ এবং ফিউজ লাগাতে প্রায় ২০/৩০ মিনিট সময় লাগে এবং একটি ট্রান্সফরমারে কাজ করতে হলে সমগ্র এলাকার বিদ্যুৎ বন্ধ করে কাজ করতে হয়। ওভারলোডের কারণে কোন এলাকার এসটি এবং এলটি তার ছিঁড়ে গেলে কমপক্ষে ২/৩ ঘন্টা লাগে তা জোড়া লাগাতে।
বিদ্যুৎ চলে যাবার আর একটি বড় কারণ হচ্ছে, অত্যন্ত নিন্মমানের চাইনিজ ১১ কেভি ট্রান্সফরমার ব্যবহার। বেশি দামে কেনা এই ট্রান্সফরমারগুলো একবার নষ্ট হলে আর ঠিক করা যায় না। তারচেয়ে বড় কথা, এগুলোর গায়ে যে ধারণ ক্ষমতার উল্লেখ আছে, প্রকৃত ধারণ ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি নাকি তারচেয়ে অনেক কম। তাই যাদের ভাগ্যে এই ট্রান্সফরমার পড়েছে, সেখানে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
দেশ বিদ্যুতে ভেসে গেলেও যতদিন এই সঞ্চালন (৩৩ কেভি) ও বিতরণ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন করা না হবে, ততদিন এই ফোর্স লোড শেডিং এর অত্যাচার আমাদের ছাড়বে না।
লেখকঃ
মাহবুব কবির মিলন
যুগ্ম সচিব
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
মন্তব্য চালু নেই