দেশ বিদেশের বিয়ের রীতি

অঞ্চল ও দেশভেদে বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা যায় বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। দেশ-বিদেশে বিয়ের রীতি-আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কিছু মজার তথ্য:

বাংলাদেশের বিয়ে

ঢাকাইয়া বিয়ে : ঢাকাইয়া বিয়েতে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পরে, বিয়ে সংক্রান্ত উভয়পক্ষের যাবতীয় আলোচনার জন্য পানচিনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ইতিবাচক সাড়া পেলে আয়োজন করা হয় মোতাসা-রাই বা ‘পাকাকথা’ অনুষ্ঠানের। সব অনুষ্ঠানেই মুখরোচক খাবারের ‘খাস আপ্যায়ন’ আয়োজন থাকে। মূল বিয়ে অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত হয় উভয়পক্ষে হলদি বা তেলাই অনুষ্ঠান। বরপক্ষ মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপাচার নিয়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হন।

এরপর আসে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। গলির মোড়ে কিংবা এলাকার মসজিদে বিয়ের কাবিননামা লেখার কাজ সেরে খাওয়া-দাওয়া, উপহার প্রদান আর আতশবাজি ফোটানোর উৎসব চলে। বিয়ের পরও আরও মাসখানেক রয়ে যায় ঢাকাইয়া বিয়ের উৎসবের এই আমেজ। বিয়ের পর কনের পিতৃগৃহে বর আর কনের বেড়াতে যাওয়াকে বলা হয় ফিরোল্টা (ফির+উল্টা বা শ্বশুরবাড়িতে আসা কনের উল্টো ফিরে যাওয়া)।

চাঁটগাইয়া বিয়ে : চট্টগ্রামের বিয়ে সাধারণত হয় বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। বিয়ের প্রাথমিক কার্যকলাপ অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সম্পন্ন হয়। তবে বিয়ের আগে আয়োজন করা হয় বউ জোড়নি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বর ও কনের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেয়াই এর মূল লক্ষ্য। এজন্য বউ জোড়নি অনুষ্ঠানে কনেকে সাজিয়ে বরের সামনে উপস্থিত করা হয়।

সিলেটি বিয়ে : সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে ধামাইল নামের একটি মেয়েলি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে সাধারণত মহিলারা গীত গেয়ে থাকেন। এ অঞ্চলের বিয়েতে হিন্দুরীতিও স্থান পেত। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বোন কর্তৃক ভাইকে রাখি বন্ধন; বরের গোসলের আগে কাস্তে দিয়ে পানিতে বিশেষ আচার পালন, মাথার ওপর কয়েক টুকরো ঘাস ঘুরিয়ে অজ্ঞাত অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা ইত্যাদি।

রাজশাহীর বিয়ে : রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতে থাকে পিঠার জয়জয়কার। বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হওয়ার পর আঞ্চলিক গীতের তালে তালে বর-কনেকে নিজ নিজ বাড়িতে মিষ্টিমুখ করানো হয়, এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় থুবড়া। সাধারণত ক্ষীর ও আন্ধাষা (তেলে ভাজা রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পিঠাবিশেষ) তৈরি করা হয়। এই মিষ্টি সাধারণত পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তৈরি করে পাঠানো হয় বর-কনের বাড়িতে।

খুলনার বিয়ে : খুলনা অঞ্চলে কোনো কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে বর আর কনেপক্ষের মধ্যে বিয়ের সময় অনুষ্ঠিত হয় প্রীতি বাকযুদ্ধ। তাও আবার বাংলায় নয়, এই তর্ক চলে পুরোপুরি ইংরেজিতে। এই ইংরেজি তর্কযুদ্ধই খুলনার বিয়ের স্বকীয়তা। বাড়ির প্রধান ফটকে বরপক্ষকে আটকে কনেপক্ষের লোকজন ইংরেজিতে কথোপকথন শুরু করে। তার জবাবে বরপক্ষকেও উত্তর দিতে হয় ইংরেজিতে। এছাড়াও বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বিয়ের রীতি রয়েছে। যেমন ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার গারোদের সমাজে একসময় বাল্যবিবাহের অনুরূপ ‘ঠ্যাঙ ধরা’ বিয়ের প্রচলন ছিল।

বিভিন্ন দেশে বিয়ে

চীন : প্রাচীন চীনে বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে আছে মেয়ে পক্ষকে যৌতুক দেয়া, বিয়ের বাগদান, ভোজ ইত্যাদি। একটি ছেলে যদি একটি মেয়েকে পছন্দ করে, ছেলে মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ঘটককে পাঠায়। বিয়ের দিন নিয়ে চীনের আরও কিছু মজার রীতিনীতি আছে। যেমনÑ বিয়ের দিন কনে লাল পোশাক পরে। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় কনেকে কাঁদতে হয়।

কনের বিদায়ের সময় বাবা-মাও চোখের জলে বুক ভাসায়। চীনের কোনো কোনো অঞ্চলে স্বামীর ঘরে প্রবেশের আগে কনেকে আগুন জ্বালানো একটি গামলা পার হতে হয়। এ রীতির অর্থ হলো, সব অমঙ্গল আগুনে পুড়ে যাক ও নতুন দম্পতির জীবন আগুনের মতো উজ্জ্বল হোক।

ফ্রান্স : বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর একটি হচ্ছে ফ্রান্স। সাদা রঙ ফ্রান্সের বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রধান রঙ। সাজগোজের অলঙ্কার, ফুল, কনের কাপড় সবই সেখানে সাদা হয়ে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, ফরাসিদের চোখে বিয়ে হচ্ছে শান্তি ও পবিত্রতার প্রতীক।

ব্রিটেন : ব্রিটিশ রীতির বিয়ে অনুষ্ঠানে কনে পদ্মফুল হাতে রাখে। ব্রিটিশদের চোখে এই ফুল সৌভাগ্যের প্রতীক। ব্রিটিশদের বিয়ের অনুষ্ঠান সাধারণত দুপুরে আয়োজিত হয়। তাদের বিয়ের কেক তৈরিতে হরেকরকম ফল ব্যবহার করা হয়। এ কেককে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম পর্যন্ত রেখে দেয়া হয়।

জার্মানি : জার্মানিদের বিয়েতে বিশেষ পার্টিতে বর ও কনেকে কেন্দ্র করে নানা মজা করা হয়। এক পর্যায়ে নাচতে নাচতে আনন্দের সঙ্গে থালা-বাসন ছুড়ে ফেলা হয়। আবার যদি স্বামী স্ত্রীকে দেখতে চায়, তাহলে স্ত্রীর বন্ধুকে ঘুষ দেয়ার মতো টাকা দিতে হয়। নইলে স্ত্রীকে দেখার অনুমোদন দেয় না বন্ধুরা।

ড. খান মুহম্মদ ইলিয়াস



মন্তব্য চালু নেই