দেশের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া মানুষটিকে কেউ মনে রাখেনি!

দেশের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়া মানুষটির কথা কেউ মনে রাখেনি। নিরবে পেরিয়ে গেছে ৮টি বছর। ৮ ডিসেম্বর ২০০৮, দিবাগত রাতে সকলের অগচরে না ফেরার দেশে চলে যান খুলনার কপিলমুনির বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মন্ডল।

অথচ তাকে স্মরণ করার জন্য এগিয়ে আসেনি কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যাক্তি বা সরকার। আজ অবধি ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়নি তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন ইহকালের আবাসস্থল।

বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মন্ডল, পাইকগাছার গর্ব। সেই কপিলমুনির মাসি হঠাৎ আর এসে বলবে না, ”কেমন আছিস বাবা ? ভালো আছিস তো ? দে কয়ডা টাহা দে, তোরা না দিলি পাব কনে ক।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের অবদান আমরা খুব গভীরভাবে অনুভব করি না। অপরাজেয় বাংলার স্থাপত্যে প্রত্যয়ী নারী সহযোদ্ধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের ত্যাগ মহিমান্বিত হলেও সে সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা অতি সীমিত। বছর কয়েক আগে

ইয়াসমিন কবীরের “স্বাধীনতা” শীর্ষক প্রামাণ্য শর্ট ফিল্মটি ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরীতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল।

৩৭ মিনিটের শর্ট ফিল্মটি গুরুদাসী মন্ডলকে নিয়ে রচিত। তিনি রাজাকারদের হাতে নির্যাতিত হন। বন্দী ছিলেন রাজাকারদের ক্যাম্পে প্রায় তিন মাস। মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করেন এই গুরুদাসীকে। তারপর থেকেই সব হারানোর বেদনায় তিনি সকল স্বাভাবিকত্ব হারিয়েছেন। যে দেশে অস্বাভাবিকতাই হচ্ছে আদর্শ আর ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে মূলধারা, সেখানে গুরুদাসীর স্বাভাবিকতার মূল্য আর কতটুকু?

স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের পরিবার ও স্বজনদের হারিয়ে তিনি তার চারপাশকে আপন করে নেন। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি এলাকায় নি:স্ব এই বীরাঙ্গনা পথে পথে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন। সামনে যার কাছ থেকে যা পান নিয়ে নিতেন, কারণ সবকিছুর উপরই তার অনেক দাবী। বেত দিয়ে পথচারীকে আঘাত করার ভয় দেখান। হয়তো তার এই অস্বাভাবিকতা হচ্ছে চলমান বিকৃতির প্রতি ঘৃণা ও ব্যঙ্গ।

কপিলমুনি এলাকায় অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন গুরদাসী। তিনি উপকথার নায়িকার মতো সবার একান্ত আপন। সব হারিয়েছেন যে দেশের জন্য, সেই দেশ গুরুদাসীকে কিছুই দিতে পারেনি। অবশ্য যেসব রাজাকার নির্যাতন করেছিল তারা আজ আছে বহাল তবিয়তে। ইতিহাসের নিষ্ঠুর প্রহসন। এখনও সেই রাজাকাররা প্রতারিত করে চলছে দেশের মানুষকে ধর্মের মুখোশ পড়ে। গুরুদাসী আমাদের বিবেকের লজ্জা ও গ্লানি। এই লজ্জা ও গ্লানি থেকে যারা মুক্তি দিবে তারা কি চেনে গুরুদাসীকে?

আজ ৮ ডিসেম্বর। ২০০৮ সালেই এই দিনে মুক্তিযুদ্ধের এই বীরাঙ্গনা মাতা চীর দিনের মতো বিদায় নেন তার প্রিয় মাতৃভূমি ও এই পৃথিবী থেকে। পুরো জীবনটাই দিয়ে গেছেন দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য। তার ৮ম প্রয়াণ দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী। যেখানে থেকো, ভালো থেকো মাসি।



মন্তব্য চালু নেই