দুই হাজার পনেরো : বিএনপি কি পারবে?

বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই এমন অবস্থায় আছে যেখানে সহিংসতা অনিবার্য। সেটা বারবারই ঘটছে এবং আমরা বারবারই দেখছি। আমরা দাঙ্গাবাজ কিম্বা সহিংস জাতি তার জয় এটি ঘটছে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি গঠনতন্ত্র বাংলাদেশ প্রণয়ন করতে পারে নি। রাষ্ট্র যার ওপর দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা যায় এমন নীতি ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত বিধিবিধান ও প্রতিষ্ঠানও আমরা গড়ে তুলি নি। যেমন, গণতান্ত্রিক বিচারব্যবস্থা, আইন প্রণয়নের প্রতিষ্ঠান, কিম্বা একটি নির্বাহী বিভাগ। মতা হস্তান্তরের কোনো শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাও আমরা তৈয়ার করতে পারি নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন সেই ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আমরা ভারি অদ্ভুত জাতি। আমরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠা হিসাবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে তাকে একদিকে দুর্বল করে রেখেছি। অন্যদিকে সেই ফাঁকি পূরণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক একটা ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছি যা দুই একবার ইলেকশান করবার পর এখন শেখ হাসিনার আমলে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বলছেন, যা করবার তাঁর অধীনেই করতে হবে। তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানকে এমন ভাবে বদলে দিয়েছেন যাতে একে আর বাংলাদেশের জনগণের সংবিধান বলে ভাবা কঠিন। সেটা এখন আওয়ামী লিগের দলীয় কর্মসূচিরই নামান্তর হয়ে গিয়েছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে একে একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা বলছি। শুধু ফ্যাসিবাদ নয়।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রথম পদপে হচ্ছে একটি উদার গণতান্ত্রিক কর্মসূচির ভিত্তিতে সমাজের সকল ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং বর্তমান অবস্থার রূপান্তরের জন্য স্বাধীনতার ঘোষণার (Proclamation of Indepependence) ‘গাঠনিক’ প্রতিশ্রুতিকে সামনে নিয়ে আসা। সেটা হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ‘নিশ্চিত করণার্থে’ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন। এটি ‘গাঠনিক প্রতিশ্রুতি’ যার ও ইতিহাসিক, রাজনৈতিক ও আইনি ন্যায্যতা বা বৈধতা রয়েছে। যদি এই ঐক্য নির্মাণে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণ আমাদের সর্বনাশের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

যদি এই উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল রা করবার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ঐতিহাসিক ঐক্যের মুহূর্তকে যথাযোগ্য মূল্য না দেই তাহলে সহিংসতা আমরা যতই চেষ্টা করি এড়াতে পারব না। কিন্তু সেটা কোনো গাঠনিক অভিমুখের দিকে যাবে না। হত্যা, হানাহানি ও নৈরাজ্যের মধ্যে খাবি খেতে থাকবে। সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী অবস্থা দাঁড়ায় আগাম বলা মুশকিল।

বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ক্ষমতারোহণের এক বছর কাটছে আগামি ৫ জানুয়ারি। জানুয়ারির ৫ তারিখকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে সহিংসতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে বকশীবাজারের ঘটনা আমরা দেখেছি। গাজীপুরে বদরে আলম কলেজ মাঠে বিএনপির সভা ছিল ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে। ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে সেখানে লাঠি মিছিল করেছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। তারা ঘোষণা দিয়েছে যেকোনো মূল্যে তারা এ সভা প্রতিহত করবে। একই দিনে একই জায়গায় তারা তাদের সমাবেশ করবে। বিএনপি আগেই অনুমতি চেয়েছে বলে মেয়র জানিয়েছেন, কারণ তাদের সভা হওয়ার কথা ছিল ২৩ তারিখ, সেদিন শেখ হাসিনা কাশিমপুর জেলের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বলে তারিখ বদল করা হয়েছিল ২৭ ডিসেম্বর। তার জন্য অনুমতিও পেয়েছে। বিএনপি বলেছে, তারা ‘যে কোনো মূল্যে’ ২৭ তারিখে গাজীপুরে সভা করবে। খালেদা জিয়া অবশ্য এর আগে স্পষ্ট বলেছেন তাঁর রাজনীতি হবে ‘শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক’। পত্রিকা থেকে জেনেছিলাম সাতাশ তারিখ সকালে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা থেকে গাজীপুরে জনসভার উদ্দেশে রওনা হবেন। তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতারাসহ ঢাকা মহানগর বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীও সঙ্গী হবেন। যেখানে বাধা আসবে, সেখানেই তারা সমাবেশ করবেন। দলীয় নেতাকর্মীদের এই দিকনির্দেশনা মেনে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাই হোক তেমন কিছুই ঘটে নি।

শান্তিপূর্ণ ভাবে সভা সমিতি করবার সাংবিধানিক অধিকার ক্ষমতাসীনরা ঘোষণা দিয়েই লংঘন করছে। জেল-জুলুম আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন তো আছে। তদুপরি ঢাকা শহরের বাইরে শহরতলিতে বিএনপি কোনো সভা করতে চাইলে ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আশাপাশি সশস্ত্র হামলার হুমকি দিচ্ছে। এই সহিংস ও সশস্ত্র পরিস্থিতির মোকাবিলা আইনি বা সাংবিধানিক ভাবে সমাধানের কোনো উপায় নাই। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কিভাবে আন্দোলনের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করে সেটাই আগামি দিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা কী হবে তা নির্ধারিত হবে।
বছরের শেষের দিকে এই পরিস্থিতি যে ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাতে বলা যায় জনগণের দিক থেকে বিএনপির ভবিষ্যৎ বিচারের জন্য এটাই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বিএনপি আদৌ আওয়ামী লিগকে মোকাবিলা করতে সম কি না। বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসাবে এই ক্ষেত্রে কী ধরনের নীতি ও কৌশল গ্রহণ করে তার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির রাজনীতির আশু ভবিষ্যৎ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের হামলার হুমকি বিএনপিকে পিছু হটিয়েছে। যুবলীগ ও ছাত্রলীগ শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে তারেক রহমানের উক্তির প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইতোমধ্যে গাজীপুরে সভা-সমাবেশের ওপর অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি তাদের কর্মসূচি স্থগিত করে। এর ফলে ২৭ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ‘যে কোনো মূল্যে’ সফল করবার দাবি ফাঁকা আওয়াজ হয়ে গিয়েছে। তার পরিবর্তে ২৭ ডিসেম্বর হরতালের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এতে বিএনপির রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে।

আওয়ামী লীগের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় ক্ষমতার সন্ধি বিএনপির পশ্চাদপসরণের একটা কারণ হতে পারে। ক্ষমতাসীনদের এই শক্তির মুখে বিএনপি দাঁড়াতে পারে নি। আগামি দিনে পারবে কি না সেটা প্রবল সন্দেহের। এই সন্ধির হিংস্রতা মোকাবিলার রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির নাই। নিয়ক্ষমতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলার অর্থ বিএনপির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা। এই পিছু হটাকে নিয়ক্ষমতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি বিএনপির নৈতিক অবস্থান হিসাবে বিবেচনা করা চলে না। এই দুর্বলতা ঢাকা কঠিন। প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোও তাই একে ‘পিছু হটাই’ বলছে (দেখুন ‘পিছু হটল বিএনপি’, দৈনিক প্রথম আলো ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪)। ডিসেম্বরের শেষে বিএনপি নিজের শক্তি যেভাবে প্রকাশ করল, তাতে বোঝা যাচ্ছে আগামি বছর বিরোধী দলের কেমন যাবে।

ক্ষমতাসীনদের জন্য রাজনীতির এই পর্যায়ে বিএনপির কর্মসূচি সশস্ত্র ভাবে মোকাবিলা ঝুঁকিপূর্ণ। বকশীবাজারের ঘটনা যারা ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা জানেন যে বিএনপির দিক থেকে পাল্টা আক্রমণ হলে সাধারণ মানুষ বিএনপির পক্ষে জড়িয়ে পড়ত। একে সামাল দেওয়া ক্ষমতাসীনদের পে সম্ভব হোত কিনা সন্দেহ। ক্ষমতাসীনদের দমনপীড়ন, সহিংসতা ও রক্তপাত মানুষ পছন্দ করছে না। বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করে এটা মানুষ যেমন বিশ্বাস করে না, তেমনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রাম করে শেখ হাসিনার পতন ঘটাতে পারবে, সেটাও মনে করে না। অতীতের অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। ফলে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা বিএনপি বর্তমান শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্তি দিক।

অথচ ক্ষমতাসীনরাও জানে বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে এখন বাধ্য। এর সুযোগও পুরোমাত্রায় তারা নেবে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তি বারবারই যে পরামর্শ তাদের স্বার্থের অনুকূল দলগুলোকে দিয়ে থাকে সেটা হলো আন্দোলন ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাবহির্ভূত যেই হোক রাজনীতি ও ক্ষমতা সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই থাকতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট রাজনৈতিক দলের বাইরে আন্দোলন উপচে পড়ুক এটা কোন পরাশক্তি চাইবে না, তাদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকলেও। উপচে পড়লে বাংলাদেশে বিরাট কিছু ঘটে যাবে, তা না। সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট দলগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল ও ক্ষমতার ভারসাম্যে যে অনিশ্চয়তা সেটা কোন পরাশক্তিই নতুন করে মোকাবিলা করতে চায় না। তাছাড়া হাজার হোক ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত উভয় পইে তাদের দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ রয়েছে। অতএব আন্দোলন যেন কখনই নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় সেটা তারা কূটনৈতিক ভাবে নিশ্চিত করতে সবসময়ই আগ্রহী। বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের উত্থানপতন এই কূটনৈতিক চাপের দ্বারাই নির্ধারিত। এই দিকটি বোঝার দরকার আছে বটে, কিন্তু এতে জনগণের মধ্যে বিএনপি কোনো আশার সঞ্চার করতে পারবে না।

সারমর্মে কূটনৈতিক ফর্মুলা হচ্ছে ক্ষমতাবহির্ভূত রাজনৈতিক আন্দোলন যেন নিছকই ক্ষমতা হস্তান্তরের আন্দোলনে সীমিত থাকে। ক্ষমতার চরিত্রে কোনো সংস্কার বা রূপান্তর দূরে থাকুক- কোনো ভাবেই বর্তমান চরিত্রে কোন হেরফের যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করতেই সকল পরাশক্তি আগ্রহী। যে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পর্কে তাদের কোনো অবস্থান নাই। আন্দোলন করতে গিয়ে মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে সম কোন রাজনীতির জন্ম যেন না ঘটে সেটাই তারা চায়। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার সংস্কার করে তাকে উদার গণতান্ত্রিক ক্ষমতায় রূপান্তরও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এক বিশাল বৈপ্লবিক কাজ।

প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি বিএনপির পক্ষে সম্ভব? উদার গণতন্ত্রকে গণশক্তিতে রূপান্তর তো আরো কঠিন ও দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের ব্যাপার। কিন্তু সেটা তো পরের কথা। সহনশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া নিয়ক্ষমতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ভাবে জনগণের পক্ষে ইতিবাচক কিছু অর্জন অসম্ভব।

কূটনৈতিক পাড়ার অসম ফর্মুলা মেনে বিএনপি আন্দোলন করলে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপির অবয় নিশ্চিত। ক্ষমতাসীনদের ক্যাডাররা বিএনপিকে শুধু সশস্ত্র ভাবেই মোকাবিলা করছে না, তাদের হাতে প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ রয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে বিএনপি কি শুধু পাল্টা মার খেয়ে যাবে, নাকি নিজেদের রা করতে সম হবে? আমরা বারবার পিছু হটা দেখছি। এই পশ্চাদপসরণ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় শক্তিশালী করছে।

বলা বাহুল্য, বল প্রয়োগ অবশ্যই রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য বিষয়। বিশুদ্ধ আহাম্মক ছাড়া এটা কেউই অবিশ্বাস করে না। এগুলো রাষ্ট্র গঠন ও রাজনীতির গোড়ার কথা। গণতান্ত্রিক কনস্টিটিউশন ও তার ওপর দাঁড়ানো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করা গেলে আইনের শাসন (অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইন ও বিচার ব্যবস্থার শাসন), নিয়মতান্ত্রিকতা (অর্থাৎ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক বিধিবিধান মেনে চলা), শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ইত্যাদি অর্থপূর্ণ হতে পারে। কারণ গণতন্ত্র কায়েম অবস্থায় নিয়ম না মানা বা সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের অর্থ হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার বিধিবিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার রার নীতি ও বিধানের ওপর দাঁড়ায় না, নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে লাঠি গুলি দিয়ে দমন করে, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ, হত্যা-গুম-খুন যেখানে নিত্যদিনের কারবার, সেখানে রাজনীতি নির্ধারণ করতে সম যে কোন পাল্টা বলপ্রয়োগ আলবৎ ‘গাঠনিক’ (constitutive) – অর্থাৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অবশ্যই দরকার। এটা বিএনপি করুক বা না করুক, যারা সমাজ, রাজনীতি, আইন ইতিহাস ইত্যাদি বিজ্ঞান হিসাবে পাঠ করেন, তাদের কাছে পরিষ্কার। এখন বিএনপি কি করবে বা কি করতে সম, সেটা তাদের ব্যাপার। খালেদা জিয়ার ‘নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন’কে আমরা কৌশলগত নাকি নীতিগত অবস্থান হিসাবে পাঠ করবো সেটা আগামি দিনে বিএনপির রাজনীতি দেখেই আমরা বুঝবো।

বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা থেকে যারা উত্তরণ চান তাদের কাছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটা পরিষ্কার। বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার আলোকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কার কোথায় কিভাবে করতে হবে এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তির পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান বোঝাতে কিভাবে আমরা সক্ষম হবো সেই পথের সন্ধান করা। এটাই সঠিক পথ। বাংলাদেশের বৈপ্লবিক রূপান্তরের স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে। তরুণদের তো অবশ্যই। এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু বিপ্লবের নামে কোনো অবাস্তব ও গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির দিবাস্বপ্ন আমাদের কোথাও নেবে না। কুয়ার মধ্যে পড়া ছাড়া। নজর মাটির দিকেই রাখতে হবে, আকাশে না। যে রাজনীতি বা যে চিন্তা বাস্তবায়নের বাস্তব পদক্ষেপ আমাদের জানা নাই বা আমরা ভাবতে সম না, সেই চিন্তা শিশুর হাতে বেলুন উড়িয়ে রাখার মতো সুতা ধরে রাখা। এর কোনো অর্থ নাই। এটা ফাটবেই। একে ছেড়ে দিন, উড়ে যাক। যে চিন্তার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা কঠিন বা অসম্ভব তেমন বিমূর্ত বাসনাকে চেনা ও পরিহার করাই এখনকার কাজ।

বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা এবং বাস্তব অবস্থায় বাস্তবিক পদক্ষেপ হিসাবে তাকে প্রয়োগের শিক্ষা আমাদের দরকার। সেই পদপে সংস্কারমূলক বা বিপ্লবী কি না সেটা হাওয়াই শ্লোগান দিয়ে বোঝা যাবে না। কংক্রিট বাস্তব চিন্তা ও পদক্ষেপ দেখেই সাধারণ মানুষ চিনবে। কিন্তু বাস্তব চিন্তা ও কর্মসূচি বই পুস্তকে পাওয়া যাবে না। বাস্তবতার বিচার করেই তা নির্ণয় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা ইতিহাস থেকে পাঠ নিতে পারি। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সমস্যা সমাধানের জন্য ছয় দফা দিয়েছিলেন। এটা তো কোনো বিপ্লবী দাবি ছিল না। অথচ সেটাই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপ নিয়েছে। কি করে উদার ও সংস্কারবাদী দাবিও বৈপ্লবিক হয়ে ওঠে তার শিা নিজেদের ইতিহাস থেকেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে।

দুই
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙতে চান নি; এ কথা বহু বছর আগে আমি বলে নিন্দিত হয়েছি। তিনি মুসলিম লীগ করেছেন, পাকিস্তানের জন্য লড়েছেন। অথচ সেই মুজিবরই স্বাধীন পাকিস্তানে ‘বাঙালি’ হবার জন্য লড়েছেন, ইসলাম বা মুসলমান হিসাবে তাঁর ইতিহাস ও পরিচয় ভুলে গিয়ে নয়। এটাও জানতেন কলকাতার উচ্চ বর্ণের ‘বাঙালি’র কাছে মুসলমানরা ‘বাঙালি’ বলে স্বীকৃত ছিল না। ইতিহাসের বিচিত্র প্রহসন যে মুসলমানকে রক্ত দিয়ে ‘বাঙালি’ হতে হয়েছে। জন্মসূত্রে তারা এই রাজনৈতিক পরিচয় লাভ করতে পারে নি। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়ে আরো অনেক কিছুই অনেকে এখন বুঝতে শিখছেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনের রাজনীতি করেন নি। তাজউদ্দীন তাঁকে জোর করলেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি। সবচেয়ে দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, নিয়ক্ষমতান্ত্রিক রাজনীতির বিধিবিধান মেনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে। আমি সবসময়ই তাঁর এই দূরদর্শিতার প্রশংসা করেছি। নিজেকে তিনি লেনিন, মাও সে তুং বা হো চি মিন মনে করেন নি। মুসলিম লীগ করা ও সোহরাওয়ার্দীর কাছে পার্লামেন্টারি রাজনীতির শিক্ষা পাওয়া শেখ মুজিবই মনে করেছিলেন। ধরা দেবার সময়ও তাঁর চিন্তা ও রাজনীতি নিজের চিন্তাভাবনার বাইরে যায় নি। শাসক হিসাবেই তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতা ধরা পড়তে শুরু করে। বাকশালী মুজিবের ইতিহাস ভিন্ন ইতিহাস।

তো আমাদের শিখতে হবে নিজেদের ইতিহাস থেকেই। শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের জনগণের সমর্থন ও সহায়তা চেয়েছেন, কিন্তু দিল্লির দাসত্ব মেনে নেন নি। শেখ হাসিনা তাঁর পিতার রক্ত বহন করতে পারেন, কিন্তু তাঁর রাজনীতির উত্তরাধিকারী নন। তিনি দিল্লির দাসত্ব মেনে ক্ষমতায় আছেন এবং ক্ষমতাদর্শিক ভাব তাজউদ্দীনের পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রী, ধর্ম নিরপেতাবাদী, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করছেন। যে কারণে তাঁর মন্ত্রিসভাতে শেখ মুজিবুরের অনুসারীদের চেয়েও তথাকথিত পেটি বুর্জোয়া বামপন্থীদেরই দৌরাত্ম্য বেশি। তিনি নিজেকে নিজে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর জীবিত থাকলে তাজউদ্দীনের মতো তাঁকেও মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করতেন।

বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার আলোকে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিমণ্ডলে বাংলাদেশে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংস্কার ও কর্মসূচি কী হতে পারে সে ব্যাপারে ব্যাপক আলাপ-আলোচনাই এখনকার কাজ। সেই রাজনীতি অন্বেষণই ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকলের কর্তব্য। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লিগের ইতিহাস যারা জানেন তারা সকলেই শেখ হাসিনার হাতে গড়া বর্তমান ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন, এটা আমি মনে করি না। কিন্তু তারা আওয়ামী লিগের সমর্থক বলে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। অন্যদিকে বিএনপি এমন কোন নীতি বা কর্মসূচি হাজির করে নি যাতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সকল নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে পারে বা বিরোধী রাজনীতির পে ব্যাপক জনসমর্থন গড়ে ওঠে। সোজা কথায় ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিএনপির ছয় দফা জাতীয় কোন সংস্কারমূলক কর্মসূচি নাই। এখানেই বিএনপির বিশাল বিপদের জায়গা।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বোঝা দরকার, সশস্ত্র রাজনীতি বা সহিংস ভাবে প্রতিপরে সহিংসতা মোকাবিলায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক কোন দল নিয়ে আমরা কথা বলছি না। আমরা কথা বলছি সেই দলগুলোকে নিয়ে যারা গণতন্ত্রের কথা বলে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারে নি। কেন পারে নি? সেটা কি কোন তথাকথিত ‘অগণতান্ত্রিক’ রাজনীতি বা শক্তির কারণে? মোটেও না। তাদের কারণেই গণতন্ত্র আজও সোনার হরিণ, যারা গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা বাকশাল কায়েম করে, একদলীয় শাসন কায়েম করতে গিয়ে নিজের দলকেই বিলুপ্ত করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের সংবিধানকে নিজ দলের দলিলে পরিণত করে। পঞ্চদশ সংশোধনী এই অবিশ্বাস্য উদাহরণ। গণবিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী ও সশস্ত্র আওয়ামী লিগ তাদের কব্জায় থাকা রাষ্ট্রের সমূহ সশস্ত্র শক্তি ব্যবহার করে ক্ষান্ত থাকে না; রাম দা, লগিবৈঠা, পিস্তল, কাটাবন্দুক মায় স্টেন গানসহ রাস্তায় সবার চোখের সামনে সশস্ত্র ভাবে প্রতিপকে মোকাবিলা করে। রক্ত ঝরায় এবং প্রকাশ্যে রাস্তায় লাশ ফেলতে দ্বিধা করে না।

ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামি লীগ যদি বলে যে তারা বিরোধী দলকে যেভাবেই হোক প্রতিহত করবে, তারা লগিবৈঠা লাঠিবন্দুক যেভাবেই হোক করবেই। এটা তারা ভয় দেখাবার জন্য বলছে না। শেখ হাসিনার সামনে সশস্ত্র ভাবে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করা ছাড়া সামনে আর কোনো পথ খোলা নাই। তিনি রাজনীতিকে এই সহিংসতার স্তরে, বারুদ, রক্তপাত ও লাশের স্তরে জেনে শুনেই নিয়ে এসেছেন। এই পথ থেকে তাঁর ফিরে যাবার কোন পথ দেখা যাচ্ছে না। অন্তত আমি দেখছি না। নতুন বছরেও না।

শেখ হাসিনা জানেন একটি দুর্বল বিরোধিতাও তাঁকে যেকোনো মুহূর্তে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। তিনি বিরোধী দলীয় কোনো কর্মকাণ্ডই তাই করতে দেবেন না। বাধ্য না হলে।

এই পরিস্থিতিতে বিএনপি কী করে বা কী করতে সক্ষম সেটাই দুই হাজার পনেরো সালে দেখার বিষয়।



মন্তব্য চালু নেই