দিনে জুতা সেলাই, রাতে হয়ে ওঠেন আশ্চর্য রঙের মানুষ
প্রচারের আলোর আড়ালে কত কবি নিভৃতে জ্বালিয়ে রেখেছেন অনুভবের প্রদীপ। যেমন মনোয়ার শাকিল। পেট চালাতে তিনি জুতোসেলাই করেন। কখনও বা করেন সংবাদপত্র ফেরি।
কিন্তু সে পরিচয়ের গন্ডিতেই তিনি সীমাবদ্ধ নন। দিনের আলো নিভে এলে তিনিই হয়ে ওঠেন আশ্চর্য রঙের মানুষ। দিনের আলোয় যে হাতে তাঁর ধরা থাকে সূচ-সুতো, সেই হাতেই তিনি তুলে নেন কলম। আর জাদুকরের মতো তাঁর হাতে খেলে যায় অলীক সব পংক্তিমালা। নক্ষত্ররা ঘন হলে বৃষ্টি নামে- এমনই এক পংক্তি এক রিক্সাচালকের মুখে শুনে চমকে গিয়েছিলেন নবারুন ভট্টাচার্য।
মনোয়ারও সেরকম চমক জাগিয়ে শোনান জল না পাওয়া পাথরে বেড়ে ওঠা সেই সব গাছের কথা। আসলে সে তো বোধহয় তাঁরই কথা। কল্পনাবিলাস নয়, আক্ষরিক অর্থেই জীবন থেকে অভিজ্ঞতার ছেনে মনোয়ার তৈরি করেন তাঁর কাব্যপ্রতিমার শরীর। একটা দুটো নয়, ছ’টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর৷ আর পাঁচটিই পেয়েছে কোনও না কোনও পুরস্কার৷ ফয়জলবাদের মুনওয়ার শাকিল এমনই এক বিস্ময় প্রতিভা। আজকাল তাঁর কাছে আর শুধু জুতো সেলাই করাতে যায় না কেউ, বরং সকলেই খোঁজ করে তার বইয়ের।
অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন। প্রথাগত পড়াশোনা বলতে যা বোঝায় সে সব কোনদিনই করা হয়ে ওঠেনি তাঁর৷ কিন্তু কল্পনার পালক যাঁর চোখের পাতা ছুঁয়ে যায়, তাঁর আর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার কী দরকার। ১৩ বছর বয়স থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি, কিন্তু পেট বড় বালাই৷ জীবন সত্যিই কাব্য নয়, তাই রুটি রুজির তাগিদে পারিবারিক জুতো সেলাইয়ের মতো পেশাকেই বেছে নিতে হয়েছিল তাঁকে৷
দোকানে দোকানে সংবাদপত্র ফেরির কাজও করেন৷ তবে হাতে সূচ-সুতো তুলে নিতে হয়েছে বলে কলম নামিয়ে রাখার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি৷ দিনের কাজ সারা হলে, নিজের স্বপ্নের সামনে বসতেন তিনি৷ লিখতেন কবিতা৷ এক এক করে খাতার পাতা যখন ভরল, তখন এল বই করার ভাবনা। ২০০৪ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়৷
জীবনকে এত কাছ থেকে যিনি দেখেছেন, তাঁর কবিতা স্বভাবতই অন্য মাত্রা দাবি করে। কোন আকাশকুসুম কল্পনা নয়, মনোয়ার তাই বলতে পারেন, মানুষের যন্ত্রণা, মানবতার বেদনা বুঝতে না পারলে সত্যিকারের কবি হওয়া যায় না। তাঁর কবিতায় তাই উঠে আসে, সেই সব গাছেদের কথা, কোনও জলসিঞ্চন যারা পায় না, পাথরের মধ্যে এমনি এমনিই যারা বেড়ে ওঠে। অ্যাকাডেমিক চত্ত্বরের বাইরে মুনওয়ারের লেখা খোঁজ দেয় অন্য এক দুনিয়ার৷ জীবনের ঘাম-রক্ত মিশেই যা আলাদা এক সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়৷
দেখতে দেখতে ছটি বই প্রকাশ হয়েছে মুনওয়ারের৷ পাঁচটি বইয়ের জন্য কোন না কোন পুরস্কারও পেয়েছেন৷ তবু কলমের অহংকারে সূচ সুতো নামিয়ে রাখেননি মুনাবর। আজও দিনের আলোয় তাঁকে লোকে দেখে জুতো সেলাই করতে। আর কবি থাকে গোপনে। তবু কবি কি গোপনে থাকে? রাত ঘন হয়ে এলে বৃষ্টি নামে মনোয়ারের কলমে, সারা দুনিয়া সকালে উঠে দেখে আবার একটা নতুন কবিতা লিখেছেন কবি মনোয়ার শাকিল। সূত্র: কলকাতা টুয়েন্টিফোর সেভেন।
মন্তব্য চালু নেই