পর্ণ ছবি’র নায়িকার মতো চেহারা হওয়ায়
দিনাজপুরে একটি পরিবার ৬ মাস একঘরে, ফতোয়াবাজ আটক
ভারতীয় পর্ণ (ব্লু ফিল্ম) ছরি’র নায়িকার মতো চেহারার মিল থাকায় একটি পরিবার’কে ৬ মাস যাবত একঘরে রেখেছে ফতোয়াবাজরা। দেখা, সাক্ষাত, আদান-প্রদান, এমনকি মসজিদে নামাজ পড়া পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ওই পরিবারের লোকজনকে। শুধু তাই নয়, প্রতিবাদ করায় ওই মেয়ের পিতা ও স্বামীকে মারধর করে হাত-পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। এই ঘটনায় ওই মেয়ের পিতা বাদি হয়ে ৯ জনকে আসামী থানায় মামলা করায় অবশেষে পুলিশ সোমবার রাতে এক ফতোয়াবাজকে আটক করেছে। ঘটনাটি এলাকায় সৃষ্টি করেছে ব্যাপক চাঞ্চল্য।
এ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটেছে, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর ৭নং আউলিয়াপুকুর ইউনিয়নের গালতৈড় কাচলডাঙ্গা গ্রামে। গ্রামের রিক্সা-ভ্যান চালক এনামুল হকের মেয়ে রেহানা বেগম (২৪)। ২০০৭ সালে রেহেনা বেগমের বিয়ে হয় দিনাজপুর সদর উপজেলার নুনাইচ সাহাপাড়া গ্রামের হুসেন আলীর সাথে। বিয়ের পরের বছর থেকেই স্বামী হুসেন আলীসহ রেহানা বেগম তার বাবার বাড়িতে বসবাস করে আসছিল। রেহানার পিতা এনামুল হক ও স্বামী হুসেন আলী দু’জনেই দিনমজুর। পাশাপাশি কর্মসৃজন, কাবিখা, কাবিটা প্রকল্পে রেহানা নিজেও কাজ করে থাকে।
গত বছরের ১৮ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেহানা বেগম কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ করে। ২৯ ডিসেম্বর চিরিরবন্দরে ওই কাজের বিল গ্রহণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে একই এলাকার রকিবুল ইসলাম ও মঞ্জুরুল ইসলাম তাকে ডেকে নিয়ে সে অন্যের সাথে দৈহিক মিলন করেছে এমন ভিডিও তাদের কাছে আছে বলে জানায় এবং কু-প্রস্তাব দেয়। বিষয়টি রেহানা বেগম অস্বীকার করলে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। কু-প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় মঞ্জুরুল ইসলাম, রকিবুল ইসলাম ও ওহিদুল ইসলাম ওই ভিডিওটি আতাবাজারের শামীম কম্পিউটার দোকানের মাধ্যমে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয় এবং ভিডিওটি রেহানা বেগমের বলে প্রচার চালায়।
পরে বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়ে গেলে গ্রামের লোকজন এই ঘটনায় গত ৩ জানুয়ারী এলাকায় বিচার-শালিস বৈঠক বসায়। বিচারে ওই এলাকার মেম্বার জালাল উদ্দিন, গ্রাম্য মাতব্বর আবু বকর সিদ্দিকসহ অন্যান্য সমাজপতিরা খারাপ কাজের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে ওই পরিবারকে একঘরে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই পরিবারের সদস্যরা কারোও সাথে কথা বলতে পারবে না, কারো বাড়িতে যেতে পারবে না, দিনমজুর হিসেবে কেউ তাদেরকে কাজে নিতে পারবে না, এমনকি মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে পারবে না।
বিচারের সময় কোন প্রকার সত্য-মিথ্যার যাচাই করা হয়নি বলে অভিযোগ করে ওই পরিবার। শুধু তাই নয়, গ্রাম্য মাতব্বরের দেয়া একঘরে করে রাখার প্রতিবাদ করায় ওই মেয়ের বাবা ও স্বামীকে মারধোর করে পা ভেঙ্গে দিয়েছে তারা। এ সময় বাড়ির খুটির সাথে বেধে মারধোর করা হয়েছে ওই মেয়েকেও। এই ঘটনায় মিমাংসার নামে ওই পরিবারকে দেয়া হয়েছে ২০ কেজি চাল ও ৩ কেজি আলু।
গত ৩ জানুয়ারী থেকে একঘরে থাকার ৬ মাস চলার পর গত ১০ই জুলাই এলাকায় ওহিদুল ইসলাম ওই মেয়েকে খারাপ কথা বললে সে প্রতিবাদ করে। এ সময় সে বিচার একতরফা ও এই বিচার মানি না বলায় ওই দিনই রেহানা বেগম ও তার তার পিতা এনামুল হককে এলাকার ওহিদুল ইসলাম, রাশেদুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, মঞ্জুরুল ইসলাম, রকিবুল ইসলামসহ অন্যান্য লোকজন ধরে নিয়ে গিয়ে গ্রাম্য মাতব্বর আবু বকর সিদ্দিকের বাড়িতে বেধে মারধোর করে। এ সময় রেহানা বেগমের স্বামী হুসেন আলীকেও ধরে নিয়ে গিয়ে বাড়ির খুটির সাথে বেধে মারধোর করা হয়। মারধোরে হুসেন আলী ও এনামুল হকের পা ভেঙ্গে দেয়া হয়। মারধোরের ফলে রেহানা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়লে পরে তাদের বাধন খুলে দেয়া হয়।
ওই দিন বিকেলে ওই এলাকার মেম্বার জালাল উদ্দিন ঘটনাস্থলে এসে এসব বিষয়ে কোথাও অভিযোগ করা যাবে না এই মর্মে ৩টি সাদা স্ট্যাম্পে তাদের সই নিয়ে ছেড়ে দেয় এবং ওই দিন থেকে ‘একঘর’ থেকে তাদেরকে সমাজে তুলে নেয়া হলো বলে ঘোষণা দেয়। এ সময় ঘটনাটি মিমাংসা করে দেয়ার নামে ২০ কেজি চাল ও ৩ কেজি আলু দেয়া হয় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে। এ সময় আহতদের চিকিৎসা করানো হবে বলেও ঘোষণা দেয়া হয়।
রেহানা বেগম বলেন, ওই ছবির মেয়েটির সাথে তার চেহারার মিল রয়েছে। কিন্তু সে এসব কাজের সাথে জড়িত নয়। বিষয়টি তদন্ত করলেই প্রমাণিত হবে। কিন্তু গ্রাম্য মাতব্বর ও মেম্বার যোগসাজস করে আমাদেরকে একঘরে করে রাখে ও পরবর্তীতে মারধোর করে।
রেহানার স্বামী হুসেন আলী ও পিতা এনামুল হক জানান, ওই পর্ণ ছবির নায়িকার সাথে রেহানার চেহারার মিল রয়েছে। কিন্তু সেটি রেহানা নয়, বিচারে আমাদের কথা কর্ণপাত করা হয়নি। এমনকি মামলা দায়ের করতেও বাধা প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি এলাকার চেয়ারম্যান হাসিবুল হাসান, মেম্বার জালাল উদ্দিন, আবু বকর সিদ্দিক ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে বলে পরিবারের লোকজন অভিযোগ করে।
এই ঘটনায় গত ২৪ জুলাই রেহানা বেগমের পিতা এনামুল হক বাদি হয়ে মেয়ের ভূয়া পর্ণ ভিডিও প্রদর্শন করে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে একঘরে করে রাখা, মসজিদে নামাজ পড়তে বাধাদান, মারপিট করে রক্তাক্ত করার প্রতিবাদে ৯ জনের বিরুদ্ধে চিরিরবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এ ব্যাপারে গ্রাম্য মাতব্বর আবু বকর সিদ্দিক জানান, খারাপ ভাষায় গালমন্দ করায় তাদেরকে একটু শাসন করা হয়েছে। খুঁটির সাথে বেধে মারধোর এবং পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে এটি স্বীকার করলেও তিনি জানান, এটা নিজেদের ব্যাপার।
এলাকার মেম্বার জালাল উদ্দিন জানান, দু’পক্ষের মধ্যে বিবাদ থাকায় আপোষ করে দেয়া হয়েছে। এ সময় একঘরে করে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর থানার ওসি এস.এম.আনিছুর রহমান জানান, ঘটনা জানার পর ঘটনাস্থলে যাওয়া হয়েছিল কিন্তু ওই পরিবার অভিযোগ দিতে চাননি যার কারনে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এক ঘরে ও সমাজচুত্য করে রাখার মামলায় আতাব আলী নামে এক ব্যাক্তিকে আটক করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, ফতোয়াকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না, তাই কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, পুলিশকে দিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
তিনি জানান, স্থানীয় সরকারের অংশ আমাদেরকে সহযোগিতা না করায় আমাদের নলেজে বিষয়টি আসেনি। আসলে আগেই ব্যবস্থা গ্রহন করা হতো। এজন্য দু:খ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই ঘটনার সাথে যারাই জড়িত তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে।
পাশাপাশি ওই এলাকার কম্পিউটারের দোকানগুলোতে পর্ণ ছবি পাওয়া গেলে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
মন্তব্য চালু নেই