দিনাজপুরের ১০ গ্রামে ফাটল
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি এলাকার ১০ গ্রামের অনেক ঘরবাড়ি, জমি ও সড়কে ফাটল দেখা দিয়েছে। ভেঙে যাওয়া বা ফাটল দেখা দেওয়া ঘরেই ঝুঁকি আর আতঙ্ক নিয়ে বাস করছে গ্রামবাসী। অনেকে রাত কাটাচ্ছে ঘরের বাইরে। কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অন্যত্র। গ্রামবাসীর অভিযোগ, গত মার্চের মাঝামাঝিতে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কয়লা তোলার সময় কম্পনে ফাটলের সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল রাতে মারাত্মক কম্পনে এ ফাটল আরো বড় আকার ধারণ করে। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), র্যাব ও পুলিশ পৃথকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানায় গ্রামবাসী। ফলে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক, উদ্বেগ কাটছে না।
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো হলো উপজেলার হামিদপুর ইউনিয়নের বাঁশপুকুর, মথিয়াপুর, কালুপাড়া, শিবকৃষ্ণপুর, বৈদ্যনাথপুর, পাতিগ্রাম, পাতরাপাড়া, কাশিয়াডাঙ্গা, বৈগ্রাম ও কাজীপাড়া। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম খনির অধিগ্রহণকৃত জমির পূর্ব দিকের বাঁশপুকুর।
ভূ-তত্ত্ববিদ সরওয়ার হক চৌধুরী জানান, ‘ভূ-গর্ভ থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কয়লা তোলার সময় কম্পনের সৃষ্টি হতে পারে। বড় ধরনের কম্পনের প্রভাবে সমতল ভূমির কিছু অংশে ফাটল দেখা দিতে পারে। তবে এতে ভয়ের কিছু নেই। ’ খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিব উদ্দিন বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিসহ উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কী কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সঠিক বিষয়টি বলা যাবে।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির জিএম ভূ-তত্ত্ববিদ এ বি এম কামরুজ্জামান বলেন, কী কারণে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী বোর্ড মিটিংয়ে কমিটি তাদের প্রতিবেদন দেবে। তিনি গ্রামবাসীর আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন। বাঁশপুকুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত তোফাজ্জল হোসেন (৬৫), মতিয়ার রহমান (৪০), হেলেনা খাতুন (৫৫) ও রুহুল আমিন (৬৫) জানান, মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে কম্পন সৃষ্টি হয়ে মাটি ফেটে যায়। কয়লাখনিতে বিস্ফোরণের কারণে মাঝেমধ্যেই মারাত্মক কম্পন দেখা দিচ্ছে। এ নিয়ে বাঁশপুকুরসহ ১০টি গ্রামের মানুষের দিন-রাত কাটছে উদ্বেগ আর উত্কণ্ঠায়।
রুহুল আমিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘খনির কারণে এখন আমাদের রাত জেগে থাকতে হচ্ছে। প্রচণ্ড কাঁপুনিতে যদি ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ে, এ ভয়ে রাতে ঘুম হয় না। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়েও যেতে পারছি না। রাতে খনির প্রচণ্ড কম্পনে ঘর থেকে এসে রাস্তায় দাঁড়াতে হয়। ’ তিনি বলেন, গত মার্চের মাঝামাঝিতে হঠাৎ করে বড় ফাটল দেখা যায়। ২৮ মার্চ প্রবল বর্ষণ হলে ফাটল বিশাল আকার ধারণ করে। এর প্রস্থ দেড়-দুই ফুট। কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি।
গত রবিবার সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া গ্রাম থেকে বাঁশপুকুর পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার সমতল ভূমি ফেটে গেছে। ফাটলের কারণে ভরা বর্ষায়ও বাঁশপুকুর গ্রামের একটি পুকুরে এক ফোঁটাও পানি নেই।
রাতের আঁধারে ফাটলে পড়ে (পায়ে আঘাত) আহত হয়েছেন বাঁশপুকুর গ্রামের গৃহিণী হেলেনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নাই। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কষ্টের সংসার। চার শতক জমির ওপর চারটি ঘর। হঠাৎ করে কাঁপতে কাঁপতে ঘরগুলা ফাটি গেইছে। এখন ঘর ভাঙি যাওয়ার ভয়ে হামার রাইতোত ঘুম হয় না। ’ বাঁশপুকুরের গৃহবধূ সানোয়ারা খাতুন বলেন, ‘ভূ-গর্ভ থেকে কয়লা উত্তোলনের সময় প্রচণ্ড কম্পন ও আওয়াজ হয়। এতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। বুক ধড়ফড় করি ওঠে। মনে হয় এই রাইত বুঝি হামার শেষ রাইত। ’ মতিয়ার রহমান বলেন, ২০ শতক জমিতে তাঁদের চার ভাইয়ের বাড়ি। বাড়িসংলগ্ন পুকুরের মাঝখান দিয়ে ফাটল চলে গেছে। ওই ফাটলের কারণে প্রবল বর্ষণেও পুকুরে এক ফোঁটা পানি নেই। ফাটল এলাকার জমিতে পানি না থাকায় আবাদও হচ্ছে না। ক্ষতিপূরণও পাচ্ছি না আমরা। ’
বড়পুকুরিয়ার গৃহবধূ মমিনা খাতুন বলেন, ‘প্রতি রাইতে আজগুবি আওয়াজ হয়া ঘর-দুয়ারগুলো কাঁপতে থাকে। হামার চারটা ঘরের সবগুলাই ফাটি গেইছে। রাইতের কালে যখন কাঁপা (কম্পন) শুরু হয়, তখন মনে হয় আর বুঝি বাঁচন নাই। ’
গ্রামের সুলতান মাহমুদ (৫৬) বলেন, ১৮ এপ্রিল রাত ৯-৪৩ মিনিটে এখানে কম্পন আর ঝাঁকুনি শুরু হয়। কয়লাখনির বয়সে তিনি এমন অবস্থা আর দেখেননি। এই বাড়ির গৃহিণী কামরুন্নাহার (২৮) বলেন, ‘আমাদের প্রতি রাত কাটছে আতঙ্ক আর নিদ্রাহীন। বিশেষ করে ফাটল ধরা ভাঙা ঘরে কোলের সন্তান নিয়ে বিপাকে আছি। ’
এদিকে ‘কয়লা খনির কারণে’ খনিসংলগ্ন ১০টি গ্রামে ঘরবাড়ি, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরায় ‘পরিবেশ, জীবন ও সম্পদ রক্ষা’ নামে একটি কমিটি আট দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন করছে। আগামী ২৭ এপ্রিল বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির প্রধান ফটকের সামনে তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করবে বলে জানান আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক মশিয়ার রহমান বুলবুল। ১০টি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার ও বাইপাস সড়ক নির্মাণ চুক্তি, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে এর আগে সম্পাদিত চুক্তি অবিলম্বে বাস্তবায়ন, খনির কারণে ভূ-গর্ভ থেকে পানি না ওঠায় দ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা, পুনর্বাসনের ৪০০ পরিবারের পানি, পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত করাসহ আট দফা দাবি রয়েছে ওই কমিটির।
দাবি আদায়ে ইতিমধ্যে সংগঠনটির আহ্বানে খনি এলাকায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়েছে। খনি কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দাবিসংবলিত একটি আবেদনপত্র দেওয়া হয়েছে। আবেদনপত্রে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান সুপারিশ করেছেন বলে জানা যায়। পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মশিউর রহমান ফাটলের ঘটনাটি নিশ্চিত করে বলেন, ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির জিএম মাইন অপারেশন (খনি পরিচালক) নুরুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলো পরিদর্শনসহ এ বিষয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কী কারণে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে তা জানতে খনির অভ্যন্তরীণ আরেকটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকায় অবস্থানরত খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিব উদ্দিন বলেন, খনির অধিগ্রহণকৃত এলাকার বাইরে ফাটল দেখা দিয়েছে। তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
খনি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি) ১৯৮৫ সালে দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার বড়পুকুরিয়া এলাকায় ৬ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটারজুড়ে ১১৮-৫০৯ মিটার গভীরতায় উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লার সন্ধান পায়। খনি উন্নয়ন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন এবং খনির উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের ৪ আগস্ট কম্পানি আইন ১৯৯৪-এর আওতায় ‘বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কম্পানি লিমিটেড’ গঠন করা হয়। ২০০৩ সালের ২৩ এপ্রিল খনি থেকে ব্যাপক ভিত্তিতে কয়লা উত্তোলনের উদ্বোধন করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই