দণ্ডিত ক্লিনিকে দণ্ডদাতা বিচারকই চিকিৎসক!
বগুরায় ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগে এক ক্লিনিক মালিককে তিনমাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. তায়ের-উর-রহমান আশিক। ওই সময় ক্লিনিকটি সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এখন খোদ ওই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধেই বিধি বহির্ভূতভাবে ওই ক্লিনিকে বসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস (ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার) করার অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া তিনি ওই ক্লিনিকের ওপরতলার একটি ফ্লাটে ক্লিনিক মালিকের সঙ্গে আবাসিকভাবে বসবাস করতেন বলেও জানা গেছে। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে গত সোমবার রাতে তিনি ফ্লাট ছাড়েন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ম্যাজিস্ট্রেট ডা. তায়ের-উর-রহমান আশিক বগুড়ায় জামায়াত-শিবির পরিচালিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ক্লাসও নিতেন। তার বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন ক্লিনিক-হাসপাতাল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হিংসাত্মকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে।
বগুড়ার বিভিন্ন ক্লিনিক মালিক অভিযোগ করে জানান, ম্যাজিস্ট্রেট আশিক তার কাছে রোগী পাঠানোর জন্য তাদের চাপ দিতেন। কেউ রাজি না হলেই র্যাব-পুলিশ নিয়ে তাদের মালিকাধীন ক্লিনিকে ও হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালাতেন। আক্রোশমূলকভাবে জরিমানা করতেন। দণ্ডাদেশ দিতেন ইচ্ছেমতো। লাখ লাখ টাকার জরিমানা পরিশোধের সামর্থ্য না থাকায় মালিক-কর্মচারি-চিকিৎসক ও সেবিকাকে কারাগারে পাঠানো হতো।
সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি শহরের ফাতেমা জেনারেল হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে চালানো অভিযানে ওই হাসপাতালের মালিক ও মেডিকেল এসিসটেনন্টকে কারাদণ্ড দেন তিনি। এ সময় মালিক-কর্মচারিকে মারধরের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গেলে বগুড়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও এসএ টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার আরিফ রেহমানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন ম্যাজিস্ট্রেট আশিক। সাংবাদিকদের সম্পর্কে ঢালাও কটূক্তি করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্লিনিক মালিকেরা শহরের সব বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করে ধর্মঘট ডাকেন। অন্যদিকে ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে বগুড়া থেকে প্রত্যাহারের দাবিতে বগুড়া প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া এলাকার ভাইপাগলা মাজার লেনের ‘আস্থা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ শহরতলীর গোদারপাড়া এলাকায় থাকাকালে ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ ম্যাজিস্ট্রেট আশিক সেখানে র্যাব-পুলিশ নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক পরিচালনা, মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত ও ওষুধ মজুদ করাসহ ‘মানহীন’ সেবার অভিযোগে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক তৌফিক রহমানের এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের দণ্ড দেন তিনি। এছাড়া ক্লিনিকটি সিলগালা করা হয়।
ক্লিনিকটি পরে শহরের ঠনঠনিয়া ভাইপাগলার মাজার সড়কে স্থানান্তর করে পুনরায় চালু হলে ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর রহমান আশিক সেখানে নিজেই রোগী দেখা শুরু করেন। বসবাসও করতেন মালিক তৌফিক রহমানের সঙ্গে ক্লিনিকের পঞ্চমতলায় একই ফ্লাটে।
আস্থা ক্লিনিকের মালিক তৌফিক রহমান বলেন, ‘গত নভেম্বর মাসে হাসপাতালটি ঠনঠনিয়া এলাকায় স্থানান্তর করে পুনরায় চালু করা হলে সেখানে নিজে থেকেই রোগী দেখার কথা বলেন ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর রহমান। বাধ্য হয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তার রোগী দেখার ব্যবস্থা করা হয়। কম্পিউটার কম্পোজ করা একটি কাগজে নিজের নাম ও পদবি নিজেই লিখে দিলে তা ক্লিনিকে সেটে দেওয়া হয়। পঞ্চমতলার একটি কক্ষে আগে থেকেই বসবাস করতেন ওই ম্যাজিস্ট্রেট। নভেম্বর মাস থেকে একই ফ্লাটের অন্য কক্ষে পরিবারসহ আমি বসবাস করছি। তার নামের পাশে ডিগ্রি হিসেবে তিনি পিজিটিসহ (পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনিং) কয়েকটি ডিগ্রি ব্যবহার করেছেন।’
বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি ডা. মোস্তফা আলম নান্নু জানান, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) বিধি অনুয়ায়ি এ ধরনের ডিগ্রি কোনো চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন কিংবা সাইনেবোর্ডে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্ত উনি (ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর রহমান) তাই করছেন।
এ প্রসঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর রহমান আশিক বলেন, ‘আমি এমবিবিএস পাশ করেছি। রোগী দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিও নেওয়া আছে।’
তবে তিনি ‘আস্থা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ এ বসে রোগী দেখার বিষয় অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার নাম ও পদবি এবং রোগী দেখার সময় উল্লেখ করে ক্লিনিকে যে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে সেটা ঐ ক্লিনিকের মালিক করেছেন।’
ফ্লাটে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল মালিক নভেম্বর মাসে ক্লিনিকের পঞ্চমতলার ফ্লাটে ওঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে তায়েব-উর রহমান আশিক শহরের বেশকিছু ক্লিনিক হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন।
এরমধ্যে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর মোমেনা নার্সিং হোম ও শাপলা বেসরকারি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে প্রতারণার দায়ে ক্লিনিকের মালিক, ভুয়া চিকিৎসক ও আয়াকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছেন।
২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল শহরের একতা জেনারেল হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করে কর্মচারিকে তিনমাসের দণ্ড দেন। ২২ এপ্রিল লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা পরিচালনা, মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ, নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন অপারেশন থিয়েটার, অস্বাস্থ্যকর (ড্যামেজ) কক্ষে ঔষধ রাখার অভিযোগে একটি ক্লিনিকে অভিযান পরিচালনা করে ৯ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড অনাদায়ে ২ লাখ টাকা জরিমানাদেশ দেন তিনি।
মোমেনা ক্লিনিকের চিকিৎসক গোলাম মহিউদ্দিন অভিযোগ করেন, ‘চিকিৎসা সনদ বাসায় থাকায় ওই ম্যাজিস্ট্রেট তাকে চরম অপদস্থ করেন। তিনি নিজে চিকিৎসক দাবি করলেও অন্য চিকিৎসককে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন।’
শহরের মফিজ পাগলার মোড় এলাকার আশরাফ নামে একজন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক অভিযোগ করে বলেন, ‘ওই ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নেতাদের অন্যরকম সখ্যতা রয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কথামতো তিনি বিভিন্ন ক্লিনিক-হাসপাতালে আক্রোশমূলক অভিযান চালান। অথচ জামায়াত-শিবিরের মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে তিনি কখনো অভিযান চালাননি। উল্টো শিবিরের সাবেক নেতার মালিকানাধীন ‘আইডিয়াল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যাটস স্কুলে নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন তিনি।’
এ প্রসঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট আশিক বলেন, ‘আইডিয়াল নামে ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক সেলিম রেজা শিবিরের সাবেক নেতা এটা আমি জানতাম না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সেখানে ক্লাস নেওয়া যদি অপরাধ হয় তবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সমর্থিত অনেক চিকিৎসকই সেখানে ক্লাস নেন। সেটা নিয়ে কেউ তো প্রশ্ন তোলে না।’
ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জিএম সাকলাইন বলেন, ‘ওই ম্যাজিস্ট্রেটের নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার নানা তথ্য বেড়িয়ে আসছে। এতোদিন তিনি ক্লিনিক মালিক ও চিকিৎসকের নানাভাবে অপদস্থ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেয়, আমরা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছি। না হলে কঠোর আন্দোলন হবে।’
এ বিষয়ে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর রহমান আশিক যে নিজেই কোনো ক্লিনিকে বসে রোগী দেখতেন বা সেখানে আবাসিকভাবে বসবাস করতেন- এ ধরনের অভিযোগ এতোদিন কেউ করেননি। রোগী পাঠানোর জন্য হুমকির বিষয়ে এতোদিন কেউ কিছু বলেননি।’
সাংবাদিকদের ডিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচি
এদিকে সাংবাদিকদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করায় ম্যাজিস্ট্রেট তায়েব-উর রহমান আশিককে বগুড়া থেকে প্রত্যাহারের জন্য রবিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে তাকে প্রত্যাহার করা না হলে সোমবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনসহ প্রশাসনের সংবাদ বর্জন করবেন সাংবাদিকরা। বৃহস্পতিবার বগুড়া প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে শহরের সাতমাথায় আয়োজিত সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এই ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিক লাঞ্ছনাকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রত্যাহারে তালবাহানা করায় জেলা প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করা হয়।
বগুড়া প্রেস ক্লাব সভাপতি যাহেদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিক নেতারা এ বক্তব্য দেন।
মন্তব্য চালু নেই