দক্ষিণ সুদানের নিভৃতচারী আদিবাসীরা
২০১৫ সাল। যেকোনো রীতিতেই বলা হোক না কেন, সময় অনেক এগিয়ে গেছে। গোটা বিশ্ব এক অভিন্ন সভ্যতার সুতোয় গাথা। আর এই সভ্যতার মানুষেরাও আধুনিক মানুষ হিসেবেই পরিচিত। বন-জঙ্গল উজার করে, নদীর বুকে বাধ দিয়ে, মহাশূণ্যে দখলদারিত্বের দৌড়সহ বিভিন্ন কায়দায় আধুনিক মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখছে। এই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে নিজেরা যেমন ‘আধুনিক’ নামধারী হয়েছে তেমনি একটি বিশাল অংশকে ‘আদিবাসী’ ‘নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠি’ ইত্যাদি নামে নামাঙ্কিত করেছে। যেমন আধুনিক আমেরিকাবাসীরা প্রাচীন আমেরিকাবাসীদের বিতারণ করে তাদের ভূমির মালিকানা গ্রহণের জন্য আদিবাসী নিধন যজ্ঞে মেতেছিল। কিন্তু এই সুতোয় বাধা সভ্যতার প্রত্যেকেই হিসেব করলে কোনো না কোনো ‘আদিবাসী’ গোষ্ঠির অংশ। অথচ সেই মানুষগুলোকেই পৃথিবীর সকল প্রান্তেই চরম দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। হয়তো এমন একদিন আসবে যখন বর্তমানের আধুনিক মানুষদের ভবিষ্যতের মানুষেরা বর্তমানের আদিবাসীদের মতো দেখবে এবং কোনঠাসা করে ফেলবে। কারণ ভবিষ্যত অতীত থেকে শিক্ষা নেয়।
বর্তমানে তেমনি কোনঠাসা হয়ে আছে কিছুদিন আগেই স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ দক্ষিণ সুদানের অনেক আরব আদিবাসী গোষ্ঠি। দেশটির একেবারে হৃৎপিন্ডের কাছাকাছি গেলেই দেখা মিলবে এই গোষ্ঠিগুলোর। উনিশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ফালাতা নামের একটি আদিবাসী গোষ্ঠি দক্ষিণ সুদানে বসতি স্থাপন করে। ইসলাম ধর্মের জাগরণের সময় পশ্চিম আফ্রিকায় থাকাকালীন সময়েই এই গোষ্ঠি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। বর্তমানে চাদ এবং দক্ষিণ সুদানেই এদের বসবাস। এই গোষ্ঠির কোনে আদমশুমারি করা না হলেও বিভিন্ন সূত্রের পরিসংখ্যান মতে এদের সংখ্যা প্রায় তিন মিলিয়ন। সবচেয়ে বেশি ফালাতারা বসবাস করেন দক্ষিণ সুদানের আপার নাইল রাজ্যে।
যাযাবর জাতি হওয়ার কারণে এই গোষ্ঠিটি সম্পর্কে বর্তমানের আধুনিক সমাজ তেমন কিছু জানে না বললেই চলে। আফ্রিকার অন্যান্য গোষ্ঠির মতো এদেরও নিজস্ব ভাষারীতি এবং সাংস্কৃতিক আদান প্রদান আছে। কিন্তু বিশাল পশুপাল নিয়ে দিনের পর দিন মরুভূমিকে বিচরণ করার কারণে এদের জন্য বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জটাই মুখ্য হয়ে দাড়ায়। তবে সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তাপে এই গোষ্ঠির মানুষই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথবা বলা ভালো, একটি দেশের রাজনৈতিক ডামাডোলে যেমন সবসময়ই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি নির্যাতনের শিকার হয় তেমনি ফালাতারাও আফ্রিকাতে বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বর্তমানে বেশকিছু বেসরকারি সংস্থা এবং জাতিসংঘের কয়েকটি গ্রুপ এই গোষ্ঠিটির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের অত্যাচারে তারা জেনেছে যে, তাদের এই পৃথিবীতে বন্ধু বলতে কেউ নেই। মুসলিম হওয়া স্বত্ত্বেও তারা আরব জাহানের মুসলিমদের চোখে সহি মুসলিম নয়, আবার খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠির কাছে তারা ‘অসভ্য’ মানুষ, তাই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে চাইলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। ফালাতা গোষ্ঠির যে সাহায্যটি সবচেয়ে বেশি দরকার হয়, তাহলো এদের গবাদি পশুর শারীরিক সুস্থতা। কারণ দিনের পর দিন এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বিচরণ এবং খাবারের অপ্রতুলতার কারণে গবাদি পশুদের বিভিন্ন রোগ হয়, যে থেকে মুক্তি পেলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তাদের। তারপরেও কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে, যদিও প্রত্যেকটি সংস্থাই কোনো না কোনো পক্ষের হয়ে কাজ করে।
মন্তব্য চালু নেই