দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কাড়াকাড়ি

এশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা মোটামুটি সবাই চায়। মোট ছয়টি দেশ দীর্ঘদিন ধরেই এই সাগরের অধিকার নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাগযুদ্ধ থেকে শুরু করে মাঝে মধ্যে সামরিক লড়াইও করেছে। চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ব্রুনাই, তাইওয়ান এবং মালয়েশিয়া প্রত্যেকেই দক্ষিণ চীন সাগরের উপর নিজ নিজ দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই লড়াই তো দীর্ঘদিনের। তাহলে হঠাৎ করে কেন এই সময়ে আবার সাগর নিয়ে বাদানুবাদ শুরু হলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের নজর ফেরাতে হবে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের দেয়া বক্তব্য এবং অপরাপর ভূ-রাজনীতির দিকে।

কিছুদিন আগেই চীন সরকার দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে জানায় যে, তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দক্ষিণ চীন সাগরের তলদেশে কমপক্ষে ২১৩ বিলিয়ন ব্যারেল খনিজ তেল আছে। চীনের এই দাবি যদি সত্যি হয় এবং দেশটি যদি সাগরের ওই অংশ কার্যত দখল করতে পারে তাহলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল মজুদকারক দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। শুধু তাই নয়, রাতারাতি সৌদিআরবকেও পেছনে ফেলতে পারবে তারা। কারণ সৌদিআরবের মজুদ তেলের পরিমান ২৬৪ বিলিয়ন ব্যারেল। এছাড়াও আছে দুই হাজার ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট হাইড্রোকার্বন প্রাকৃতিক গ্যাস।

প্রাকৃতিক সম্পদের দাবি দাওয়া নিয়ে লড়াই তো আছেই। যেহেতু এই ছয়টি দেশের মধ্যে চীন অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তিশালী তাই তর্ক-বিতর্কে এখন পর্যন্ত চীনই এগিয়ে। তাই বলে অন্য দেশগুলো তাদের দাবি জানাতে পিছিয়ে নেই। ২০১২-১৩ সালে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরেছিল চীন। ইন্দোনেশিয়া দাবি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইন অনুসারে ইন্দোনেশিয়ার ভূখণ্ড থেকে সাগরবক্ষ পর্যন্ত ২২০ কিলোমিটার জায়গা ইন্দোনেশিয়ার। কিন্তু চীন এই দাবির যুক্তি অনুসারে উল্টো দাবি জানায় যে, চীন ভূখন্ড থেকে ৯০০ কিলোমিটার পর্যন্ত তাদের অধিকৃত অঞ্চল। কার্যত ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যে সমুদ্রসীমা নিয়ে চীনের দ্বন্দ্ব সেখানে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় স্কারবার্গ সোল। এই পুরো অঞ্চলটি মৎস, উল্লেখযোগ্য নৌরুট, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য বিখ্যাত।

১৯৪০ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশিদের সঙ্গে সমঝোতার প্রেক্ষিতে চীন তাদের একটি মানচিত্র তৈরি করেছিল। ওই মানচিত্রের হিসেব অনুযায়ীই এখন চীন দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাচ্ছে। এই কারণে শুরু থেকেই চীন তার সমুদ্রসীমাবর্তী দ্বীপগুলোতে সামরিক স্থাপনা তৈরি শুরু করেছিল। মোটকথা, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনই প্রথম শক্তিমত্তা প্রদর্শনে সামরিক আয়োজন শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে অন্য পাঁচটি দেশ চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেনদরবার হলেও চীনের পক্ষ থেকে কোনো নমনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

দক্ষিণ চীন সাগর1তবে সাগরে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বেশ কয়েকবার নাড়াচাড়া দেয়ার চেষ্টা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন এজেন্সির দেয়া তথ্যানুসারে দক্ষিণ চীন সাগরে আনুমানিক ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার কথা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এই সংস্থাটি ঠিক কোন তথ্যের ভিত্তিতে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে তা পরিস্কার করেনি। তবে তারা এটাও দাবি করেছে যে, চীন কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। তাই এমতাবস্থায় দক্ষিণ চীণ সাগর নিয়ে যে শুধু এশিয়ার ছয়টি দেশ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রই উদ্বিগ্ন তা নয়। হিসেবের বাইরে থেকে রাশিয়াও এই রাজনীতির অংশ হয়ে আছে, যা আমরা অল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।

রাশিয়ার কাছে প্রাকৃতিক গ্যাস একটি অস্ত্রের নাম। আরও নিখুত করে বলতে গেলে, বর্তমান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে গ্যাস একটি অব্যর্থ অস্ত্র। যে অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি ইউরোপকে বেশ কয়েকবার ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। আর এই ঘায়েল করার কাজে পুতিন ব্যবহার করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ব গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে। গোটা ইউরোপ জুরে গ্যাজপ্রম যে মনোপলি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। গত বছরের জিএইট সম্মেলনেও নেতৃবৃন্দ গ্যাসপ্রমের আধিপত্যবাদিতা নিয়ে কথা তোলেন। কিন্তু তাতে অবশ্য কোনো কাজ হয়নি।

২০০৬ সালেই মূলত গ্যাজপ্রম কৃষ্ণ সাগর বন্দর রক্ষার জন্য ইউক্রেনে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এবং সেই থেকে আজ পর্যন্ত ইউক্রেনের সঙ্গে যত ঝামেলার সূতপাত এবং যুদ্ধাবস্থা তার সবকিছুর পেছনে আছে গ্যাজপ্রম এবং রাশিয়ার গ্যাস অস্ত্র প্রয়োগ। একমাত্র জ্বালানির প্রশ্নেই ইউরোপ-রাশিয়া পরস্পর পরস্পরের কাছে আসে। গোটা ইউরোপের ত্রিশ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে এবং এর অধিকাংশই ইউক্রেন হয়ে বর্হিবিশ্বে যায়। আর এই কারণেই ইউক্রেন রাশিয়ার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ। এখন রাশিয়া চাচ্ছে ইউরোপ যাতে বাকী ৭০ শতাংশ গ্যাসও তাদের কাছ থেকেই কেনে, কারণ তাতেই একমাত্র এই মুহূর্তে রাশিয়ার অর্থনীতি বাঁচানো সম্ভব।

কিন্তু ইউরোপের এই গ্যাসযুদ্ধের মাঝেও রাশিয়া অন্য এক জায়গায় বন্দুক তাক করে আছে। আর সেটা হলো দক্ষিণ চীন সাগর। দ্বন্দ্বরত ছয়টি দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যতদিন জিইয়ে থাকবে ততদিন রাশিয়া এই সাগর প্রশ্নে কোনো উচ্চবাচ্য করবে না এটাই স্বাভাবিক। কারণ এই মুহূর্তে এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এরও অবশ্য কারণ আছে। রাশিয়া তার সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়কার মানচিত্র ব্যবহার করে খুব সহজেই দক্ষিণ চীন সাগরের উপর তাদের দাবি জানাতে পারে। ঠিক এই রাজনৈতিক অবস্থাতেই রাশিয়া চীনকে কোনো উস্কানি না দিয়ে, উল্টো চীনে তাদের গ্যাস কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। যাতে চীন সরকার ইউরোপের কোনো দেশে গ্যাস রপ্তানি করতে না পারে। অথবা বলা ভালো, চীন ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির চিন্তা করলেই আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইন অনুযায়ী দক্ষিণ চীন সাগরের উপর নিজেদের অধিকার চেয়ে বসতে পারে রাশিয়া। আর এতে করে চীনকে প্রতিবেশি পাঁচটি দেশ ছাড়াও ক্ষমতাধর দেশ রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে জড়াতে হবে, যা এই মুহূর্তে চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।



মন্তব্য চালু নেই