তোমাদের যা বলার ছিলো বলছে কি তা বাংলাদেশ?

১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১। হঠাৎ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো খবরটা, শিয়ালবাড়ি খালের লাগোয়া ইটখোলার কাছে টাটকা এক বধ্যভূমির হদিস মিলেছে। ধারণা করা হচ্ছে সপ্তাহখানেক আগে অপহৃত বুদ্ধিজীবিদের ওখানেই হত্যা করে ফেলে রেখেছে ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) খুনীরা। গোটা ঢাকা ভেঙ্গে পড়লো রায়েরবাজারের সেই জংলাভূমিতে। এবং তারা কেউ এমন নৃশংস দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। গত ন’মাস ধরে প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী হত্যা করা পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মমতার বিচারে রীতিমতো শিশু বলে রায় পেলো জামাতে ইসলামীর ক্যাডারদের নৃশংসতার কাছে। চোখ বাধা, হাত বাধা শরীরগুলোকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। মেরে ফেলার আগে অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতার সর্বোচ্চ পরীক্ষা নিয়েছিলো গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদদের রাজনৈতিক নেতৃত্বাধীন এই আল-বদররা। যেন পন করেছিলো বুলেট বাঁচানোর।

পচা লাশের তীব্র দূর্গন্ধ আশে পাশের মাইলখানেক জায়গা জুড়ে। ম্যাগনামের মেরিলিন সিলভারস্টোন যখন সেখানে পৌছলেন দেখলেন অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য। ওই দূর্গন্ধকে উপেক্ষা করেই লাশের মিছিলে প্রিয়মুখ খুজছে স্বজনরা। কিন্তু চেনার উপায় নেই। প্রতিটা লাশ বিকৃত করে ফেলেছিলো ইসলামের ঢাল নিয়ে মওদুদীবাদ কায়েমের লক্ষ্যে নামা মুসলমান নামের মুনাফিকগুলো। (স্মরণ করলে দেখবেন তাদের উত্তরসূরী শিবিরের হাতে নিহতদের ক্ষেত্রেও একইরকম সিগনেচার নৃশংসতা থাকে)। এদিক ওদিক পড়ে আছে অজস্র হাড়গোড়, মাথার খুলি। তার মানে অনেকদিন ধরেই এখানে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী এসব উন্মাদ খুনে। (প্রসঙ্গত,মঈনুদ্দিন আশরাফের মতো কাদের মোল্লারও জবাই করে লাশ ফেলার ভেন্যু ছিলো শিয়ালবাড়ি)। মেরিলিন মাঠের মাঝে পড়ে থাকা একটি কঙ্কালকে সামনে রেখে উৎকণ্ঠ স্বজনদের একটি ছবি নিলেন। ঢালের নীচে ইটভাটায় পড়ে থাকা লাশগুলোকে লেন্সে বাগাতে একটু নীচু জায়গায় নামতেই তাকে প্রথমবারের মতো টলিয়ে দিলো একটি দৃশ্য। একটি কুকুর খাচ্ছে বুদ্ধিজীবিদের একজনকে। মোট চারটি ছবি তুলেছিলেন মেরিলিন (বাকিগুলো ক্রিশ্চিয়ান সিমনপিয়েত্রি ও আব্বাসের)। রায়েরবাজার তার মনোজগতকে এমনই নাড়া দিয়েছিলো যে এই পেশাটাই ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু ফেরার পর রেসকোর্সের বক্তৃতাই তার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। তারপর হিমালয়ের এক মঠে চলে যান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ এই ফটো্গ্রাফার।

ফেরা যাক মানবতা বিরোধী যেই ভয়াবহতায়। পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ একটাই। ঘাতকরা চেয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে তাই তারা নির্মূল করতে চেয়েছিলো এদেশের শীর্ষ মেধাবীদের। পুরোপুরি না হলেও আংশিক সফল হয়েছিলো তারা সেই মিশনে। যদিও অপারেশন ইনচার্জ মইনুদ্দিন এবং জল্লাদের ভূমিকা পালন করা আশরাফ এখনও নাগালের বাইরে। মইনুদ্দিন এখন ইংল্যান্ডের বিশাল ইসলামী নেতা হিসেবে জাঁকিয়ে বসেছে যেমন বসেছে আশরাফ যুক্তরাষ্ট্রে। তাতেও বাকিদের রেহাই হয় না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে ইতিমধ্যে প্রায় পচিশ কোটি ডলার খরচ করে ফেলা জামাত ক্ষমতায় ফিরতে একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে একটাই কারণে। আর যাবতীয় সব কিছু বাদ দিলেও এই এক বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের দায়ে এতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহযোগ ও দায়বদ্ধতায় জামাতের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যেকেরই মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত। মরিয়া এসব খুনীদের এবং তাদের সহযোগী ও পৃষ্টপোষকদের যাবতীয় মিথ্যাচারে মধুর প্রপোগান্ডায়, উগ্র সাম্প্রদায়িকতায় এবং ধর্মের আফিমে মোহিত হওয়ার আগে রায়েরবাজার বধ্যভূমির এই ছবির এলবামটা আরেকবার দেখবেন প্লিজ। তারপরও যদি বিবেক সায় দেয় তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে আপনাকে কেউ ঠেকাবে না। কারণ অমানুষের তো বিবেচনাবোধ থাকে না। বিবেকও না।

1971 179530_10151012138243363_505357404_n 282726_10151009679793363_1560218391_n 283602_10151009677953363_203343621_n 333490_10151009671853363_1387122376_o 376379_10151012140918363_1015050799_n 399324_10151012139808363_1173127830_n 428811_10151012140583363_310814322_n 484604_10151009675403363_1856405692_n 523612_10151009659373363_1995973310_n 529039_10151012137608363_1689611026_n 529275_10151009663923363_1005856267_n 534521_10151012139148363_213175199_n 540929_10151009661948363_1206465759_n 555799_10151012136968363_1310413781_n 599964_10151009666898363_1926831248_n

ওমী রহমানের ফেইসবুক থেকে সংগ্রহীত



মন্তব্য চালু নেই