‘তোমরা মানুষ হবে কবে?’
জানিনা আমাদের সমাজের গন্তব্য কোথায়? তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতির আলোকে সহজেই অনুমান করা যায়- আমাদের সমাজ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের সামজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে!
আমার অবুঝ মনটাকে নিয়ে পড়েছি যত্তসব ঝামেলায় । চোখের সামনে অন্যায়-অবিচার কিংবা কোনো নিপীড়নের ঘটনা দেখলেই মনটা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। আর সমানতালে হৃদয়েও রক্তক্ষরণ হতে থাকে। যতক্ষণ না প্রতিবাদ কিংবা এ বিষয়ে কিছু একটা করবো, ততক্ষণ আর শান্তি নেই। আজও সকাল থেকে হৃদয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আর একজন পুরুষ হিসেবে নিজের প্রতি খুবই ঘৃণা আর ক্ষোভ হচ্ছে। সমাজের পুরুষ রূপী কিছু অমানুষের পশুর মতো আচরণে যেন আমাদেরকে সমাজে বেঁচে থাকায় কষ্টকর হয়ে পড়েছে। নারীদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলাই দুষ্ককর হয়ে পড়েছে। কেননা, আমার কোন বোন যদি পুরুষ রূপী এসব অমানুষের কুৎসিত কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করে বলেই ফেলেন, পুরুষরা এতো হিংস্র ও পশুর মতো কেন? তবে তাদেরকে কী জবাব দিবো। জানি তাদের এসব প্রশ্নের কোন জবাব নেই, তাই একজন পুরুষ হিসেবে খুবই ক্ষোভ হচ্ছে।
সেই সাথে নিজের মা-বোন, ভাগ্নি-ভাতিজি ও অন্যান্য স্বজনদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। চিন্তিত তাদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়েও। শুধু তাই নয়, তাদের স্বাভাবিক চলাচল নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছি। এ উদ্বিগ্ন শুধু আমাকেই করেনি, আজ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যেই তা ছড়িয়েছে।
কেননা, একের পর এক নারীরা যেভাবে অনাকাঙ্খিত ঘটনার শিকার হচ্ছেন, তাতে সমাজের স্বাভাবিকতা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে। এক ঘটনার ক্ষোভ-কষ্ট না ভুলতেই আরেকটি বিভৎস ঘটনা ঘটছে। অপরাধীদের বিচার হচ্ছে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সমাজ যেন নির্বিকার। এইতো ক’দিন বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের টিএসসি চত্বরে বেশ কিছুসংখ্যক যুবক প্রকাশ্য দিবালোকে নারীর ‘শ্লীলতাহানি’ করলো। এতে টান দিয়ে কারও কারও শাড়ি খুলে নিলো, আবার কারও স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিলো, কয়েকজনকে প্রায় বিবস্ত্রও করে অন্যায় আবদার পূরণের চেষ্টাও করলো।কিন্তু কোন অপরাধীই গ্রেফতার হলো না, রাষ্ট্রীয় দুর্বলতায় কাউকে বিচার আওতায় আনা গেল না। বরং পুলিশ প্রধান বললেন ‘এটা দু-চারটা ছেলের দুষ্টুমী ছাড়া আর কিছুই নয়।’ এছাড়া প্রতিবাদকারীদের উল্টো লাঠিপেটা ও লাঞ্চিত করা হলো। জানি না এই দুষ্টুমির শেষ কোথায়?
এই দুষ্টুমিরই ধারাবাহিকতায় গেল বৃহস্পতিবার রাতে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে এক গারো তরুণীকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে পাঁচ যুবক গণধর্ষণ করলো, এরপর উত্তরার একটি রোডে ফেলে গেল অপরাধীরা। এই ঘটনায় শুক্রবার দুপুরে ওই তরুণী বাদী হয়ে পাঁচ যুবকের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা দায়ের করলেন। কিন্তু এতে কী! ঘটনার ৪৮ ঘন্টাও কোনো অপরাধী গ্রেফতার হলো না, এমন কী তাদের চিহ্নিতও করা যায়নি। তাহলে আর কী হবে! পুলিশ প্রধানের কাছে আমার প্রশ্ন এই ঘটনাটিকে কি বলবেন অতি দুষ্টুমি না অন্য কিছু?
এ নিয়ে যেভাবে সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল সেটাও হয়নি। তাহলে আমাদের সমাজের গন্তব্য কোথায়? এর আগে আমরা দেখিছি, নারায়নগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে বাসে নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সেগুলোরও কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি বলেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদেরকে বারবার দেখতে হচ্ছে। জানি না আর কত ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হবে আমাদেরকে!
আমরা সবাই জানি, ভারতের দিল্লি শহরে বাসে একটি গণধর্ষণের ঘটনায় সে দেশের সামাজিক আন্দোলন রাষ্ট্রকে কতটা নাড়িয়ে দিয়েছিল। শেষ পর্যণ্ত সে দেশের সরকার আইন সংশোধন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একের পর এক ঘটনা ঘটলেও সেভাবে সামাজিক আন্দোলনও গড়ে উঠছে না, আর এতে অপরাধীদের বিচারও হচ্ছে না। যে কারণে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ক্রমেই হিংস্র ও অসভ্য হয়ে উঠছে আমাদের সামাজিক বন্ধন।
শুক্রবারের ঘটনায় গত দুই দিনে তেমন কোনো সামাজিক আন্দোলন কিংবা প্রতিবাদ লক্ষ্য করা না গেলেও সামাজিক সোস্যাল মিডিয়া ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ফেইসবুক-টুইটারে অনেকেই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এখানে দু-চারজনের প্রতিক্রিয়া হুবহু তুলে ধরা হলো-
ঢাকা থেকে জ. ই মামুন নামের একজন তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আয়নায় ধর্ষকের মুখ! চলন্ত মাইক্রোবাসের ভেতরে একটা মেয়েকে ৫ টা হায়েনা মিলে ছিড়ে খুঁড়ে ফেললো, আর আমরা সবাই চুপ করে বসে আছি! আমাদের কোথাও কোনো বিকার নেই, প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, বিদ্রোহ বিপ্লব নেই। অথচ এই আমরাই কত ফালতু বিষয় নিয়ে আসমান জমিন একাকার করে ফেলি! মনে পড়ে, ভারতে যখন যাত্রীবাহী বাসে এক মেডিকেল ছাত্রী গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো, তখন আমাদের সে কি প্রতিবাদ, নিন্দার ঝড়, ফেসবুক উত্তাল! আর এখন আয়নায় নিজের মুখ, তাই সবাই মুখে কুলূপ এঁটে বসে আছি!’
‘আমাদের কোনো কিছুতেই আর কেন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না- কেউ বলতে পারেন? আমাদের ধমনীতে কি আর মানব রক্ত প্রবাহিত হয় না? কেবলই গোলামি, চাটুকারিতা, পরনিন্দা এবং পরশ্রীকাতরায় ঠাসা আমাদের হৃদপিন্ড? মানুষ হিসেবে, তার চেয়েও বেশি পুরুষ হিসেবে- নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হয়!’
ঢাকা থেকে মোহনা হক তার স্ট্যাটাসে বলেন, ‘যেভাবে ধর্ষণ শুরু হয়েছে তাতে করে ঘর থেকে বের হওয়াই তো দায় হয়েছে। পুরুষ মানুষেরা এত খারাপ কেন। প্রত্যেকে পুরুষের ঘরেই তো মেয়ে মানুষ আছে হয় মা না হয় বোন না হয় স্ত্রী না হয় মেয়ে। তাহলে কেন তারা অন্যের মেয়ের সঙ্গে এমন আচরণ করে। এভাবে চলতে পারেনা। বাইরে গেলেই পুরুষদের শকুনি দৃষ্টিতে ধর্ষিত হই কতবার সে কেবল আল্লাহই জানে। কয়েকদিন দেখলাম বাইক এ যাওয়ার সময় হাই সেক্সি বলে চিৎকার করে উঠছে। কেন এত অনিরাপদ আমরা। আমরা নিরাপদে চলতে চাই।বাইরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে চলতে চাইনা।
হে পুরুষ তোমরা মানুষ হবে কবে!!’
ইশিতা পায়েল তাঁর স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘এক সাথে সর্ব স্তরের জনগণকে জেগে উঠতে হবে। দেখেন না টিএসসির ঘটনায় শুধু মাত্র কিছু সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি ছিল। তাতে কোন লাভ হয়নি। মিডিয়া কাভারেজ অনেক বড় সফলতা আনতে পারে। এক যোগে যদি সবাই মিলে একটা বড় ধরনের প্রতিবাদ/ পাল্টা আক্রমণ / বিক্ষোভ করা যায়। তবে কিছু আশা করা যায়। একটা কথা মনে রাখা দরকার, পুরুষ মানেই ধর্ষক নয়! আর বিশ্বাসটা পুরুষদেরই আনতে হবে।’
মোঃ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সে বাংলাদেশের নাগরিক। গারো বলে তাকে অন্য ভাবে দেখা উচিত না। সবচেয়ে বড় পরিচয় সে মানুষ,একজন নারী।’
মোক্তার হোসাইন নামে অপর একজন তার স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘দিন,দিন জানোয়ারদের উৎপাত বেড়েই চলছে এদের থামানোর কি কোন উপায় নেই, যে হারে বারছে, কিছু দিনের মধ্যে হয়তো আমরা দেশ,বিদেশে ধর্ষকের জাতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করবো এই পৃথিবীতে, এর জন্য মনে হয় বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবেনা।’
এদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ শনিবার এক বিবৃতিতে মাইক্রোবাসে গারো তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় ধিক্কার জানিয়ে বলেছেন, একের পর এক ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ-নিপীড়নের কোনো ঘটনারই বিচার হচ্ছে না। অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। সরকার নির্বিকার। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। উপরন্তু নিপীড়নের বিচারপ্রার্থীদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে।
তারা বলেন, বিচারহীনতার ধারায় এখন দেশ চলছে। ধর্ষক-নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে কি সরকার দেশকে ধর্ষক-নিপীড়কদের ‘অভয়ারণ্যে’ পরিণত করতে চায়? সরকার যেখানে নির্বিকার, সেখানে জনগণকে নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবেও বলে মন্তব্য করেন তারা। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান সিপিবি নেতারা।
তাই এব্যাপারে রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে কোনো বিচার না চেয়ে সমাজের সবার প্রতি আহবান জানাবো- অবনতিশীল বাংলাদেশকে চূড়ান্ত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে আসুন, সময় থাকতে আমরা সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই এবং আমাদের দেশ-জাতি ও সমাজকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করি। অন্যথা এর মাসুল যে সবাইকে একদিন দিতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সবশেষে প্রতিবাদী নারীদের সূরে ওই পুরুষরুপী নরপশুদের উদ্দেশ্যে বলবো- হে পুরুষ, তোমরা মানুষ হবে কবে?
লেখক:
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক। ই-মেইল:[email protected]
মন্তব্য চালু নেই