“তোমরা মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে”
সুরা আলে ইমরানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু হচ্ছে হযরত মারিয়াম (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর মায়ের মানত বা নাজর, মারিয়ামের জন্ম, ঈসা (আ.) ও ইয়াহিয়া (আ.)’র জন্মের বিস্ময়কর ঘটনা। এ সুরায় এসেছে:
إِذْ قَالَتِ امْرَأَةُ عِمْرَانَ رَبِّ إِنِّي نَذَرْتُ لَكَ مَا فِي بَطْنِي مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّي إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
৩৫. (তিনি তখন শুনছিলেন ) যখন ইমরানের স্ত্রী বলছিল: ‘‘হে আমার রব ! আমার পেটে এই যে সন্তানটি আছে এটি আমি তোমার জন্য নজরানা দিলাম সে তোমার (খেদমতের) জন্য মুক্ত করব ৷ আমার এই নজরানা কবুল করে নাও৷ তুমি সবকিছু শোনো ও জানো৷’’
এই আয়াতে মারিয়াম (সা.আ.)’র জন্মের প্রাক্কালে তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের ইবাদত-ঘরের খাদেম করার ব্যাপারে তাঁর মায়ের প্রতিজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মারিয়ামের মা তথা ইমরানের স্ত্রী যখন গর্ভবতী হন তখন তিনি ভেবেছিলেন যে তাঁর পেটের সন্তানটি হবে ছেলে। তাই তিনি তাকে ইবাদত-কেন্দ্রের খাদেম করার মানত করেছিলেন। কিন্তু সন্তান জন্ম নেয়ার পর দেখা গেল যে ছেলের পরিবর্তে একটি মেয়ে জন্ম নিয়েছে তখন তিনি বিস্মিত হলেন। তাই এই মানত পালন করা সম্ভব হবে না বলে তিনি মনে করছিলেন।
কিন্তু মহান আল্লাহ মারিয়াম (সা.আ.)’র মায়ের এই মানতকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন এবং মারিয়ামকে সুশিক্ষিত করার জন্য হযরত জাকারিয়া (আ.)-কে তাঁর অভিভাবক করেন যিনি ছিলেন তাঁর খালু। মারিয়াম যতই বড় হতে থাকেন ততই তাঁর খোদাভীরুতা, জ্ঞান ও মহত্ত্ব প্রকাশিত হতে থাকে। পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে: যখনই জাকারিয়া মারিয়ামের মেহরাবে তথা (ইবাদত-গৃহ-সংলগ্ন মারিয়ামের ঘরে) প্রবেশ করতেন তখনই তাঁর কাছে ফল-মূল দেখতে পেতেন (যা ঐ ঋতুতে পাওয়া যেত না)। জাকারিয়া সবিস্ময়ে প্রশ্ন করতেন: এইসব খাবার তোমার কাছে কোথা থেকে আসে? মারিয়াম জবাবে বলত: আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে৷ আল্লাহ যাকে চান, বেহিসাব দান করেন ৷
এর পরের কয়েকটি আয়াতে হযরত জাকারিয়া (আ.)’র সন্তান হওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর আবারও মারিয়াম (সা.আ.)’র গৌরবময় ও পবিত্র জীবনের কথা এসেছে পবিত্র কুরআনে। এই সুরার ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِذْ قَالَتِ الْمَلاَئِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللّهَ اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ عَلَى نِسَاء الْعَالَمِينَ
‘তারপর ফেরেশতারা মারিয়ামের কাছে এসে বললোঃ হে মারিয়াম! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করেছেন, তোমাকে পবিত্রতা দান করেছেন এবং সারা বিশ্বের নারী সমাজের মধ্যে তোমাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিজের সেবার জন্য বাছাই করে নিয়েছেন৷’
পবিত্র কুরআন ঈসা (আ.)-কে অত্যন্ত বড় মর্যাদাসম্পন্ন নবী হিসেবে উল্লেখ করেছে। তিনি কাদা মাটি দিয়ে পাখির কাঠামো তৈরি করে তাতে ফুক দিলে আল্লাহর ইচ্ছায় তা জীবন্ত পাখিতে পরিণত হত। তিনি জন্মগত অন্ধত্ব দূর করতেন ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতেন এবং আল্লাহর নির্দেশে মৃতকে জীবিত করতেন। তিনি সব সময় তাঁর অনুসারীদের বলতেন: মহান আল্লাহ আমার ও তোমাদের প্রতিপালক। তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত কর (আমার ও অন্য কারো নয়)! আর এটাই হল সরল পথ!
যারা ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে সহিংস আচরণ বা যুদ্ধ করে কুরআন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলে এবং ইসলামের অনুসারীদের জন্য সম্মান ও স্বাধীনতা চায়।
সুরা আলে ইমরানের ৭২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ একদল ইহুদির ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছেন যারা মুসলমানদের ঈমান দুর্বল করার চক্রান্ত করছিল। ১২ জন ইহুদির ওই দলটি এই পরিকল্পনা নেয় যে তারা প্রথম দিন রাসূল (সা.)’র কাছে এসে প্রকাশ্যে ঈমান আনার কথা ঘোষণা করবে, কিন্তু সন্ধ্যার সময় কাফির হয়ে যাবে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তারা এ মিথ্যা কথাটি বলবে যে, আমরা কাছ থেকে মুহাম্মাদের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে (শেষ নবী বা মুহাম্মাদের) যেসব বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেইসব বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর আচরণ ও বৈশিষ্ট্যের মিল নেই। আর এ জন্যই তার ধর্ম ত্যাগ করেছি। তারা ভেবেছিল এই মিথ্যাচারের ফলে মুসলমানদের ঈমান দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু আল্লাহ সুরা আলে ইমরানের ৭২ নম্বর আয়াতে ইহুদিদের এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন।
মুবাহিলা সুরা আলে ইমরানে উল্লেখিত আরো একটি বড় ঘটনা। এই সুরার ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَمَنْ حَآجَّكَ فِيهِ مِن بَعْدِ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْاْ نَدْعُ أَبْنَاءنَا وَأَبْنَاءكُمْ وَنِسَاءنَا وَنِسَاءكُمْ وَأَنفُسَنَا وأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَةُ اللّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ
“এই জ্ঞান এসে যাওয়ার পর এখন যে কেউ এ ব্যাপারে তোমার সাথে ঝগড়া করে, হে মুহাম্মাদ ! তাকে বলে দাও: ‘ এসো আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রগণকে, তোমাদের পুত্রগণকে৷ আর আমাদের নারীদেরকে, তোমাদের নারীদেরকে, আর আমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের নিজেদেরকে, তারপর আল্লাহর কাছে এই মর্মে দোয়া করি যে,যে মিথ্যাবাদী হবে তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক।”
এখানে বলা হয়েছে যে একদল খ্রিস্টান বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হন। বিতর্কে খ্রিস্টানরা বলছিল যে ঈসা (আ.) নিজেই ছিলেন খোদা বা স্রস্টা। তারা তাদের এই ধারণার বিরুদ্ধে রাসূল (সা.)’র অকাট্য যুক্তিকেও মেনে নিচ্ছিল না। তাই তিনি মিথ্যাবাদীর ওপর অভিশাপের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আহ্বান জানান। অর্থাৎ, উভয় পক্ষই প্রভুর কাছে এই দোয়া করবেন যে তাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তারা যেন আল্লাহর অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যায়। এই পদক্ষেপ পরের দিন পর্যন্ত স্থগিত থাকে।
খ্রিস্টানরা নিজেদের মধ্যে এ কথা বলাবলি করলো যে মুহাম্মাদ (সা.) যদি পরের দিন তাঁর সাহাবীদের নিয়ে আসেন তাহলে স্পষ্ট হবে যে তাঁর দাবিগুলো মিথ্যা, আর যদি তিনি নিজের পরিবারবর্গ ও প্রিয়জনদেরকে নিয়ে আসেন তাহলে এটা স্পষ্ট হবে যে তাঁর নবী হওয়ার বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। কারণ, কেউ কখনও নিজের প্রিয়জন ও পরিবারবর্গকে আল্লাহর অভিশাপ এবং বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে চায় না। যদি দ্বিতীয় অবস্থাই দেখা যায় তাহলে আমরা আর মুবাহিলা বা পরস্পরকে অভিশাপ দেয়ার অনুষ্ঠানে অংশ নেব না।
পরদিন সকালে দেখা গেল বিশ্বনবী (সা.), জামাতা ও চাচাতো ভাই আলী (আ.), কন্যা ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) এবং নাতি হাসান ও হুসাইন (আ.)-কে নিয়ে মুবাহিলা অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত স্থানে এসেছেন।
বদর ও অহুদ যুদ্ধ সম্পর্কিত আলোচনা সুরা আলে ইমরানের আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। যেমন, এই সুরায় এসেছে:
وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
(১৩৯) ‘তোমরা মনমরা হয়ো না,দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো৷
এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে,তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও ৷ এ – তো কালের উত্থান পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি ৷ এ সময় ওই অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা যথার্থ ( সত্য ও ন্যায়ের ) সাক্ষী হবে –কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।’
এই আয়াতে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় এবং অহুদ যুদ্ধে তাদের পরাজয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম সেনাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। মুহাজিরদের পক্ষে পতাকা ছিল আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ.)’র হাতে। আর আনসারদের পতাকা ছিল সাদ বিন উবায়দার হাতে। মুসলমানদের সাজ-সরঞ্জাম ছিল খুবই কম। অন্যদিকে কাফির সেনাদের সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও বেশি। তাদের সবার কাছেই ছিল অস্ত্র ও যথেষ্ট রসদ এবং সাজ-সরঞ্জাম। তা সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের হারিয়ে দিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন।
কিন্তু অহুদের যুদ্ধে মুসলমানরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন একদল মুসলিম সেনা শত্রুদের কৌশলের দিকে লক্ষ্য না রেখে গনিমত লাভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ-অবস্থান ত্যাগ করায় শত্রুরা মুসলিম সেনাদের ওপর অতর্কিতে পেছন থেকে হামলা করে। ফলে মুসলমানরা পরাজিত হয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।
সুরা আলে ইমরানে এইসব জয়-পরাজয়ের আলোকে জিহাদ ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা তুলে ধরেছে। যেমন, মুমিনদের প্রতি অদৃশ্য খোদায়ী সাহায্য, বিজয় সম্পর্কে আশাবাদী হওয়া ও হতাশ না হওয়া, যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়-প্রতিরোধ চালিয়ে যাওযা, শত্রুর মোকাবেলায় ভীত না হওয়া ও পালিয়ে না যাওয়া, যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি, খোদায়ী পরীক্ষা এবং যুদ্ধের ময়দানে চরম দুরবস্থার মধ্যেও আল্লাহর ওপর ভরসা করার গুরুত্ব। এইসব শিক্ষা সব যুগের জন্যই, বিশেষ করে আগ্রাসন-কবলিত দেশগুলোর জন্য জরুরি।
এ ছাড়াও মুসলিম-ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ সুরা আলে ইমরানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বিশ্বনবী (সা.) সুরা বাকারা ও সুরা আলে ইমরান পাঠের ফজিলত সম্পর্কে বলেছেন: এই দুই সুরা দুই ফেরেশতার আকৃতি নিয়ে বিচার-দিবসে তাদের পাঠকের জন্য শাফায়াত করে তাদের বেহেশতে নিয়ে যাবে।
মন্তব্য চালু নেই