তৃণমূলের কাঠগড়ায় বিএনপির কেন্দ্র
বিএনপির সরকার বিরোধী আন্দোলনের দীর্ঘসূত্রতা চাপ বাড়াচ্ছে দলটির তৃণমুল নেতা-কর্মীদের ওপর। দু’মাসের বেশি সময় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরও কার্যকর কোনো ফল না আশায় তাদের অভিযোগের তীর এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে নিস্প্রভ আন্দোলনে হতাশ মাঠ পর্যায়ের এসব নেতা-কর্মী।
তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের ‘ব্যবসা আর সম্পদ বাঁচাতেই’ মাঠে নামছে না। আর তারা না নামায় কর্মীরা মাঠে নামতে সাহস পাচ্ছেন না। যদিও তারা প্রত্যাশা করছেন, ঢাকায় আন্দোলন না হলেও সারাদেশ থেকে ‘রাজধানী বিচ্ছিন্ন থাকায়’ দ্রুতই সরকার আলোচনায় বসতে বাধ্য হবে।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে খুলনা বিভাগের একটি সাংগঠনিক জেলার প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, মামলা-হামলা-গ্রেফতার প্রতিনিয়তই মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। ঢাকা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের পথ আরো সহজ হতো। প্রায় দুই মাস সারাদেশ থেকে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন থাকলেও সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার কারনেই সরকার কোনো আলোচনায় বসতে চাচ্ছে না। তবে ‘শত নির্যাতন’ সহ্য করেও তুণমূল বিএনপি আন্দোলন চালিয়ে যেতে চায় বলে জানান তিনি।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, অনির্দিষ্টকালের অবরোধে বিএনপির তৃণমূল নেতৃত্ব এখন অনেকটাই পরিশ্রান্ত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মামলা আর গ্রেফতার আতঙ্ক। এক বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় লাগাতার আন্দোলন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এ কারণে তাদের দৃষ্টি এখন ঢাকার দিকে। নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির ডাকা আন্দোলনে আগে থেকেই অসংখ্য মামলায় জর্জরিত তারা।
এরপরও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে তারা কর্মসূচি অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছেন। তবে ঢাকার নেতাদের ভূমিকায় অখুশি তারা। কেন্দ্রীয় এসব নেতারা কি করছেন সেই প্রশ্ন তাদের? ঢাকা মহানগরের কর্মকা-ে আগের মতোই হতাশ তৃণমূল বিএনপি। রাজধানীর ব্যর্থতার কারণেই আন্দোলনের সুফল আসছে না বলে মন্তব্য আসছে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বর্ষপূর্তি দিন (৫ জানুয়ারি) অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করেছে এই সব নেতা-কর্মী। কিন্তু ঢাকায় কোনো আন্দোলন জমাতে পারেনি মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর বিএনপি। শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না নেতা-কর্মীরা।
নেতা-কর্মীদের মাঠে নামাতে অবরোধ-হরতালের সঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল ও গণমিছিলের মতো কর্মসূচি দিলেও রাজধানীর কোথাও এই কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়নি। যদিও দুই মাসের মধ্যে এই প্রথম গত শুক্রবার রাজধানীর বেইলী রোডে ঝটিকা মিছিল করেছে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। স্বল্প সময়ের ওই মিছিলে ২০-২৫জন নেতা-কর্মীকে দেখা গেছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শাখাটির নেতা-কর্মীরা।
সূত্রগুলো জানাচ্ছে, দীর্ঘ সময়ে ঢাকার মেয়র ছিলেন ঢাকা মহানগর বিএনপির প্রাক্তন আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। ঢাকার অধিকাংশ ওয়ার্ড কমিশনার তার অনুসারী। নির্বাচনের আগে তার নেতৃত্বে ঢাকার আন্দোলন ‘ব্যর্থ’ হওয়ার কারনে দলের হাইকমান্ড নেতৃত্ব পরিবর্তণ করে দায়িত্ব দেন মির্জা আব্বাসের ওপর। তবে খোকাকে ‘অপমানজনক’ সরিয়ে দেওয়ার পর মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে কাজ করেননি তারা।
সংগঠন পূনর্গঠনের সময়ে এ নিয়ে তখন বিভেদ প্রকাশ্যও হয়ে ওঠে। আন্দোলন শুরুর পর তাই কোনো ধরনের সহযোগিতা করছেন না তারা। কারন আন্দোলন সফল হলে ক্রেডিট পাবে মির্জা আব্বাস, আর নেতা-কর্মীরা আঙ্গুল তুলবে খোকার দিকে। এছাড়া ঢাকা মহানগর বিএনপির পূনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই আকস্মিকভাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন দলের হাইকামান্ড। রাজধানীতে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারার কারন হিসেবে এই বিষয়টিও দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে।
যদিও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির এক সদস্য দাবি করেন, ‘ঢাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে থেকে দেখা মাত্র গুলি করার মানসিকতায় মিছিল-মিটিংয়ের সুযোগ নেই। তাছাড়া ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ভয়তো আছেই। এ অবস্থায় নেতা-কর্মীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। জেলা-উপজেলার মতো ঢাকায় মাঠে নামার সুযোগ নেই। তারপরও এই ধরনের চরম প্রতিকুল পরিস্থিতিতে ঢাকায় আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে সর্বস্ব ত্যাগের কথা জানিয়ে নওগাঁ জেলা বিএনপির সভাপতি মো: শামসুজ্জোহা বলেন, তৃনমূল নেতা-কর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। যতদিন এই আন্দোলনে কার্যকর ফল না আসবে ততদিন আন্দোলন চালিয়ে যেতে এখানকার নেতা-কর্মীরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে ঢাকায় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে সরকারের ওপর বেশি চাপ তৈরি করা সম্ভব হতো বলে মনে করেন তিনি।
দীর্ঘ এবং লাগাতার আন্দোলনে নেতা-কর্মীদের মাঝে কোনো ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি দাবি করেন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের এই শীর্ষ নেতা আরো বলেন, ‘প্রতিনিয়িতই আমাদের নেতা-কর্মীদের নামে অসংখ্য মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তবে তারা ভীত নয়, আর এসব নিয়ে ভাবছেন না তারা। যতদিন প্রয়োজন তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।’
বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চান বলেন, ‘নির্যাতন সহ্য করে তৃনমূল কেন্দ্রের বার্তা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সরকার নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্র্রিকভাবে আন্দোলন করতে দিচ্ছেনা। মামলা দিচ্ছে, গুলি করছে। আমাদের কাজ আমরা করছি, এখন ঢাকার কাজ ঢাকা করতে পারলে হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে বলার কিছু নেই। তবে আন্দোলন সফল হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’রাইজিংবিডি
মন্তব্য চালু নেই