তুমি রয়ে গেছ নীরবে
লিমন আহমেদ : ‘মেয়েদের একটা স্বভাব হচ্ছে, একবার কোনো কারণে যদি তারা মুগ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তারা মুগ্ধ হতেই থাকে। এখন আমি যদি এই মহিলার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করি, তিনি সেই আচরণেরও সুন্দর ব্যাখ্যা বের করবেন এবং আবারো মুগ্ধ হবেন। ছেলেদের ভেতর এই আচরণ দেখা যায় না। তারা মুগ্ধ হতে চায় না। কোনো কারণে মুগ্ধ হয়ে গেলে প্রাণপণ চেষ্টা করে মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠতে।’
লেখক হুমায়ূন আহমেদ ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসে হিমুর মুখে এ কথাই প্রকাশ করেছিলেন। তবে কি তাই ঘটেছে ব্যক্তি হুমায়ূনের জীবনে! নয়তো সবকিছুতেই মুগ্ধ হওয়া ছিল যার অভ্যাস; সেই মানুষ কেন হঠাৎ হারিয়ে গেলেন! হারিয়ে যাওয়ার মতো সময় কি তার পেরিয়ে গিয়েছিল? তবুও চলে যাওয়ার মানে কী এই কোনো কারণে পৃথিবীর প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাওয়া হুমায়ূন প্রাণপণ চেষ্টা করে মুগ্ধতা কাটিয়ে উঠেছেন? চলে গেছেন প্রিয় মানুষ, জোছনা, শ্রাবণ মেঘের দিন কিংবা লিলুয়া বাতাসের অপূর্ব পৃথিবী ছেড়ে।
জন্ম-পরিচয়
আজ ১৩ নভেম্বর (রোববার), হুমায়ূন আহমেদের ৬৮ জন্মবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের বাদশা হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিনে তার প্রতি জানাই শুভেচ্ছা। সাহিত্যাঙ্গনের এই কিংবদন্তি জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে। তার বাবা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। তার বাবা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পিরোজপুর মহকুমার এসডিপিও হিসেবে কর্তব্যরত অবস্থায় শহীদ হন।
তার বাবা লেখালেখি করতেন ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। বগুড়া থাকার সময় তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন। গ্রন্থের নাম দ্বীপ নেভা যার ঘরে। তার অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন বিজ্ঞান শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিক; সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট। হুমায়ুন আহমেদের তিন ছোট বোন শিকু, শিফু ও মনি।
ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান। ডাকনাম কাজল। তার বাবা নিজের নাম ফয়জুর রহমানের সঙ্গে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন।
ছাত্র হুমায়ূন
বাবার চাকরি সূত্রে নেত্রকোণা, দিনাজপুর, বগুড়া, সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, বরিশালে তার শৈশব কেটেছে। সেই সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন এবং রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে সব গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
পরে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিজ্ঞানে ইন্টারমেডিয়েট পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
হুমায়ূন আহমেদ মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন এবং ৫৬৪ নম্বর কক্ষে তার ছাত্রজীবন অতিবাহিত হয়। এমএসসি শেষে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পলিমার রসায়ন বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি লাভ করেন।
অধ্যাপক
কর্মে প্রবেশ করেন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ লেখেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় একসময় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন তিনি।
স্বামী ও বাবা হুমায়ূন
১৯৭৩ সালে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম স্ত্রীর নাম গুলতেকিন আহমেদ। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে। তিন মেয়ের নাম বিপাশা আহমেদ, নোভা আহমেদ, শীলা আহমেদ এবং ছেলের নাম নুহাশ আহমেদ। অন্য আরেকটি ছেলে অকালে মারা যায়। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগ থেকে শীলার বান্ধবী এবং তার বেশ কিছু নাটক-চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনেত্রী শাওনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। এর ফলে সৃষ্ট পারিবারিক অশান্তির অবসানকল্পে ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয় এবং ওই বছরই শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলেমেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যাটি মারা যায়। ছেলেদের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ূন।
আমাদের হুমায়ূন আহমেদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের ছাত্রজীবনে সাহিত্যে যাত্রা শুরু করেন ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসের মাধ্যমে। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ তার দ্বিতীয় গ্রন্থ। তারপর থেকে যেখানেই হাত দিয়েছেন হুমায়ূন সেখানেই সোনা ফলেছে। সময়ের অববাহিকায় দীর্ঘদিনের সাহিত্য জীবনে তিনি রচনা করেছেন প্রায় ৩০০-র তো উপন্যাস; যা বিশ্ব সাহিত্যে একজন লেখক হিসেবে তাকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা।
তার রচনাসমগ্রের মধ্যে এইসব দিনরাত্রি, জোছনা ও জননীর গল্প, মন্দ্রসপ্তক, দূরে কোথাও, সৌরভ, নি, ফেরা, কৃষ্ণপক্ষ, সাজঘর, বাসর, গৌরীপুর জাংশান, বহুব্রীহি, আশাবরি, দারুচিনি দ্বীপ, শুভ্র, নক্ষত্রের রাত, আমার আছে জল, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, মাতাল হাওয়া, শুভ্র গেছে বনে, বাদশাহ নামদার, এপিটাফ, রূপা, আমরা কেউ বাসায় নেই, মেঘের ওপারে বাড়ি, আজ চিত্রার বিয়ে, এই মেঘ, রৌদ্রছায়া, তিথির নীল তোয়ালে, জলপদ্ম, আয়নাঘর, হুমায়ূন আহমেদের হাতে পাঁচটি নীলপদ্ম ইত্যাদি অন্যতম।
বাংলা সাহিত্যের নতুন যুগের স্রষ্টা ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যকে সার্বজনীন করে তুলতে এই কিংবদন্তি কথাশিল্পীর অবদান ইতিহাস হয়ে থাকবে। শুধু সাহিত্যেই নয়, তার নাটক ও সিনেমায় তিনি এমন কিছু চরিত্র নির্মাণ করেছেন, যেগুলো আশ্চর্যরকম জীবন্ত। হুমায়ূন আহমেদের তৈরি করা বিচিত্র সব চরিত্র অগুনতি মানুষকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, স্বপ্নে ভাসিয়েছে। এক-একটি চরিত্র পাঠক-দর্শকদের কাছে একেকটি নতুন আবিষ্কার।
সাহিত্যের চরিত্রগুলোই বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে তার নাটক-সিনেমায়। হুমায়ূনের গড়া এসব চরিত্রে কখনো কখনো তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের প্রতিরূপ।
হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে আমরা তাই খুঁজে পাই কখনো হিমু, কখনো বা মিসির আলী, আবার কখনো কখনো শুভ্র। তার তৈরি করা চরিত্রের জনপ্রিয়তা ব্যক্তি হুমায়ূনকেও কখনো যেন ছাড়িয়ে গেছে।
এছাড়াও বাকের ভাই, মুনা, মাজেদা খালা, লীলাবতী, রূপা, কঙ্কা চরিত্রেরাও তাকে যুগে যুগে অমর করে রাখবে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের অন্তরে।
বাকের ভাইয়ের স্রষ্টা!
হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তি হয়ে আছেন বাংলাদেশের টিভি নাটকের জগতেও। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্য নাটক রচনা শুরু করেন তিনি। ১৯৮০ কিংবা ১৯৯০-এর দশকে টেলিভিশনে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের নাটকগুলো এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, তার সৃষ্টি করা চরিত্রদের বিপদে রাস্তায় নেমে আসত মানুষ।
‘কোথাও কেউ নেই’, নাটকে বাকের ভাইকে ফাঁসি না দেয়ার জন্য লেখকের বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন দর্শকেরা। দর্শকদের মিছিল বের হয়েছিল। কথা শোনেন নি বাকের ভাইয়ের প্রাণদাতা হুমায়ূন। বড্ড বেরসিক (!) ছিলেন। তার অন্যতম নাটকগুলোর মধ্যে এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, অয়োময়, আজ রবিবার, তারা তিনজন, আমরা তিনজন, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছার স্বাগতম, জল তরঙ্গ, ইবলিশ উল্লেখযোগ্য।
চলচ্চিত্রের জাদুকর
একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবেও হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় এক নাম। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,‘সব গুণী মানুষ একে একে চলে যাচ্ছে। হুমায়ূনকে হারিয়ে অনুভব করছি, আপনজন হারানোর বেদনা। সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রের জন্য আমরা যারা কাজ করে আসছি, হুমায়ূন আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি মানুষকে হলমুখী করেছিলেন।’
মূলত তার চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহ তৈরি হয় নব্বই দশকের প্রথম দিকে। এই আগ্রহ আর সীমাহীন স্বপ্ন ছিল জীবনের শেষভাগেও। মোট আটটি ছবি নির্মাণ করে গেছেন তিনি। আটটি ছবি হলো- আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, আমার আছে জল আর ঘেঁটুপুত্র কমলা।
সম্মানিত মানুষ
দীর্ঘদিনের সাহিত্য জীবনে একজন লেখক হিসেবে প্রায় সবই তিনি অর্জন কিংবা জয় করে নিয়েছিলেন। পাঠক, ভক্ত, সম্মান, টাকা- সবকিছুই তিনি পেয়েছিলেন দু’হাত ভরে। আর স্বীকৃতিস্বরূপ নানা সময়ে ঘরে উঠেছে নানা পুরস্কার। তার মধ্যে রয়েছে সাহিত্যে-বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, লেখক শিবির পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পদক, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক, এবং চলচ্চিত্রে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার ইত্যাদি।
আমারে ছাড়িয়া রে বন্ধু কই গেলা রে…
মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন মলাশয়ের ক্যান্সারে ভুগছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আরোগ্যের আশায় দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই (বৃহস্পতিবার) স্থানীয় সময় ১১টা ২০মিনিটে নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষ। এর আগে, ১২ দফায় তাকে ক্যামোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর তার কিছুটা শারীরিক উন্নতি হলেও, শেষ মুহূর্তে শরীরে অজ্ঞাত ভাইরাস আক্রমণ করায় দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ১৯ জুলাই ২০১২ তারিখে না ফেরার দেশে চলে যান হুমায়ূন আহমেদ।
মন্তব্য চালু নেই