ঢাবি ছাত্রদের আবাসিক হল: অছাত্ররা আয়েশে, ছাত্ররা কষ্টে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হল ১৩টি। এসব হলে মোট ধারণক্ষমতা ৮ হাজার ৬৫১ জন। কিন্তু সেখানে থাকছেন প্রায় দ্বিগুণ। বৈধ ছাত্ররা জায়গা না পেলেও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী, চাকরিজীবী, সাংবাদিকেরা ঠিকই দখল করে আছেন হলগুলোর বিভিন্ন কক্ষ। ১১টি হলে মোট ২ হাজার ৭৭৭টি কক্ষ আছে। এক শয্যার কক্ষ রয়েছে ৮০৭টি। দুই, তিন, চার ও পাঁচ শয্যার কক্ষ রয়েছে ১ হাজার ৯৭০টি। এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষের ৪৮৯টি অর্থাৎ ৬১ শতাংশই অছাত্রদের দখলে। বাকি কক্ষগুলোর মধ্যে ৯৭৮টিতে সাধারণ ছাত্রদের পাশাপাশি ১ হাজার ৯৮০ জন অছাত্র থাকছেন। ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১টি হল সরেজমিনে ঘুরে প্রতিবেদন লিখেছেন আহমেদ জায়িফ ও আসিফুর রহমান।
শহীদুল্লাহ্ হল
২৯৬টি কক্ষের এই হলে ৮১১ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এখানে সব মিলিয়ে ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী থাকেন। হলের মূল ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের এক শয্যাবিশিষ্ট ৩১টি কক্ষের সব কটিতেই থাকেন অছাত্ররা। ১৪০টি দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষের ২৮০ জন ছাত্র থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে থাকেন মাত্র ২৮ জন, বাকিরা সব অছাত্র।
হলের ২৩১ ও ২৩২ নম্বর কক্ষ নিয়ে একাই থাকেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আমিনুল ইসলাম (২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষ)। এই ভবনে পুরোনোদের মধ্যে ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের (মাস্টার্স শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে) ছাত্রও রয়েছেন।
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ব্যাচের ছাত্রদের মাস্টার্স শেষ হয়ে গেলেও আমার এখনো শেষ হয়নি। স্নাতকে আমার দুই বছর গ্যাপ ছিল। মাস্টার্সেও এক বছর গ্যাপ হয়ে গেছে। এ বছরই আমি মাস্টার্স শেষ করব।’ দুই কক্ষে একা থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাশের কক্ষে আমারই বন্ধু থাকে। মাঝেমধ্যে আমার এলাকা থেকে কেউ এলে সেখানে থাকে।’
নিয়ম অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা মূল ভবনে থাকার কথা থাকলেও অছাত্ররা দীর্ঘদিন দখল করে থাকায় দুটি বর্ধিত ভবনে গাদাগাদি করে থাকতে হয় ছাত্রদের। বর্ধিত ভবন দুটোতে ১২৫টি চারজনের কক্ষ। কিন্তু এখানে সব কটিতে ছয় থেকে আটজন করে থাকেন। এর মধ্যে অন্তত ৬৩টি কক্ষের ১৩৯ জন অছাত্র।
বর্ধিত ভবন-১-এর দুটি গণরুমে থাকেন ৪৩ জন ছাত্র। এই ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার চার শয্যার ২০টি কক্ষে থাকেন অন্তত ১৮০ জন ছাত্র। বর্ধিত ভবন-২-এর তিনটি গণরুমে মোট ৮২ জন প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকেন।
হলে অছাত্র থাকার বিষয়টি স্বীকার করে প্রাধ্যক্ষ আইনুল ইসলাম বলেন, ‘এটা শুধু আমার হলে না, প্রায় সব হলেই থাকে।’ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণকে রাজনৈতিক দাবি করে তিনি বলেন, ‘ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা হল ছাড়ছেন না। এঁদের রাত ১১টার সময় গেলেও কক্ষে পাওয়া যায় না। তাই ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। উপাচার্যের সঙ্গে কথা হয়েছে, পুলিশ নিয়ে এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মাস্টার্স শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হল থেকে ছাত্রদের বের করে দেওয়া সম্ভব হলে গণরুমের সংকট থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন এই প্রাধ্যক্ষ।
মাস্টারদা সূর্য সেন হল
সূর্য সেন হলের ৩৮৬টি কক্ষে ৫৭৪ জনের আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু হলটিতে রয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৩৩৫ জন। হলটির ১৯০টি কক্ষেই এক বা একাধিক অছাত্র ও বহিরাগত থাকেন। ২৪৮টি একক কক্ষের বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতাদের দখলে, যাঁদের ১২০ জনের ছাত্রত্ব নেই। অন্য ১৩৮টি কক্ষের ৫৭টিতে ১৭৭ জন অছাত্র থাকেন।
ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম থাকতেন এই হলের ৩০৫ নম্বর কক্ষে। প্রায় পাঁচ বছর আগে হল ছেড়ে দিলেও কক্ষটি এখনো তালাবদ্ধ রয়েছে। ওই কমিটিরই তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. এরশাদুর রহমান চৌধুরী দুই শয্যার কক্ষে একা থাকেন। ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. মুস্তাফিজুর রহমান ও বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক মোবারক হোসাইন হলের কক্ষ ছেড়ে দিলেও সেখানে এখনো কোনো ছাত্র উঠতে পারেননি।
ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বর্তমান সভাপতি আবিদ আল হাসানেরও ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে। তিনিও এই হলের দুই শয্যার (৩৪৬ নম্বর) একটি কক্ষে একা থাকছেন। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বর্তমানে ইভনিং এমবিএ করছি। আমি এক ছোট ভাইয়ের বরাদ্দ পাওয়া রুমে থাকি। সে বাইরে থাকে।’
সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে এক শয্যা ও দুই শয্যার যে কক্ষগুলো রয়েছে, তার কোনোটিতে তিনজন (এক শয্যার কক্ষে), কোনোটিতে থাকছেন ছয়জন (দুই শয্যা) করে। এই হলে গণরুম রয়েছে ২২টি। এই কক্ষগুলোতে প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্বের প্রায় ৪৮২ জন ছাত্র গাদাগাদি করে থাকছেন। এ ছাড়া ছাদে কিছু ছাত্রকে থাকতে দেখা যায়।
জানতে চাইলে হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল স্বীকার করেন যে তাঁর হলে কিছু অছাত্র ও বহিরাগত থাকেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে অনেককে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সিদ্দিকী নাজমুল আলমসহ অন্যদের কক্ষগুলোতে কেউ না থাকার বিষয়টি তিনি জানেন না। বরাদ্দ দিলেও কক্ষে উঠতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, কেউ অভিযোগ করলে বিষয়টি দেখা হয়। কিন্তু এমন অনেকেই হয়তো আছে, যাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়, ফলে কেউ অভিযোগও করে না।
কবি জসীমউদ্দীন হল
মোট ৩৯৭ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ১২০টি কক্ষের কবি জসীমউদ্দীন হলে থাকেন প্রায় ১ হাজার ৫৫ জন। চার শয্যার প্রায় প্রতিটি কক্ষে থাকতে হয় ১০ জন করে। দুই শয্যার ৩৯টি কক্ষের ২৫টিতেই অন্তত একজন করে অছাত্র বা বহিরাগত থাকেন। তিন ও চার শয্যার ৮১টি কক্ষের ৩০টিতে অন্তত ৮৫ জন অছাত্র থাকেন। এ ছাড়া ৫১৬, ৫১৯, ৫২০, ২০৬, ২২২, ২২০ ও ৪১৯ নম্বর কক্ষগুলোতে ১৩ জন বহিরাগত থাকেন। হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক বি এম এহতেশাম আলাদা দুই শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে একা থাকেন। হলের ৪২১ নম্বর কক্ষে এক বহিরাগত বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সমাজসেবা-বিষয়ক সম্পাদক কাজী এনায়েত থাকেন।
হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, ‘হল প্রশাসন তো কোনো কাজই করে না। তারা যদি সপ্তাহে এক দিন এসেও রুমে রুমে কথা বলে, তাহলেও অনেকে চলে যেত।’ এ মাসেই তিনি স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন বলে জানান।
কক্ষে জায়গা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে হলের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের গণরুম ও ছাদের চিলেকোঠায় থাকতে হয়। গত শুক্রবার রাতে হলের উত্তর পাশের ছাদের চিলেকোঠায় দুটি বিছানা পেতে চারজনকে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। এই হলের আটটি গণরুমে ২৩৫ জন শিক্ষার্থী থাকেন।
হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রহমত উল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তো জানো, আমরা কতটা অসহায়। এদের কাছে আমরা অনেক জায়গায় জিম্মি হয়ে গেছি। আবাসিক শিক্ষকদের সর্বশেষ বৈঠকেও আমি বলেছি, এখন রুমগুলোতে তালা দেওয়ার সময় হয়েছে। আমার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি গিয়ে রুমগুলোতে তালা দিয়ে বলব, যেন তারা চলে যায়। আর কোনো উপায় নেই। সবাই বলে, কাউন্সিলটা হোক, চলে যাবে। কিন্তু কেউ যায় না।’ তিনি বলেন, ‘যদি এমন করি, বাস্তবতাটা কী বলো। ওরা হলে ভাঙচুর করবে। আমি ওদের বহুবার চিঠি দিয়েছি। কিন্তু বলে কাউন্সিল, কাউন্সিল।’ তিনি ছাত্রদের বরাদ্দ দেওয়ার পরও হলে উঠতে না পারার বিষয়টি স্বীকার করেন।
হল প্রশাসন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না। আমরা যতটা পারা যায় নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি। আমার প্রভোস্ট জীবনে চেষ্টা করেছি পরিস্থিতি পাল্টানোর। কিন্তু যারা রাজনীতি করে, তারাই তো দখল করে রাখে। যারা বলে তারা দেশের মানুষের কল্যাণে ভবিষ্যতে রাজনীতি করবে, তাদের কাছে আন্তরিকতা পাই না, তাদের সহযোগিতা ছাড়া এটা দূর করা সম্ভব না।’
শেখ মুজিবুর রহমান হল
এই হলের ১০৪টি চার শয্যাবিশিষ্ট কক্ষ ও ৮টি পাঁচ শয্যাবিশিষ্ট কক্ষে মোট ৪৭২ জনের থাকার কথা থাকলেও অন্তত ১ হাজার ৮৬ জন থাকেন। তবে এঁদের মধ্যে অন্তত ৭২টি কক্ষে ২১৫ জন থাকেন, যাঁদের ছাত্রত্ব শেষ। হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াজ আল রিয়াজ ২১২ নম্বরের চারজনের কক্ষে একা থাকেন। ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া হলের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজ মুর্শেদ রয়েছেন ২১০ নম্বর কক্ষে। ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া শেখ নূর কুতুব থাকেন ২১২ নম্বর কক্ষে। হলের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সদস্য আশরাফুল ইসলাম (২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষ) থাকেন ৫১৪ নম্বর কক্ষে।
হলের সাতটি গণরুমে গড়ে ২৮ জন করে এবং আরও ২৩টি কক্ষে গড়ে ১৪ জন করে থাকেন। বাকি কক্ষগুলোর প্রতিটিতে আটজনের বেশি শিক্ষার্থী থাকেন।
এই হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, ‘হলের নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি।’ ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হলে থাকার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য না করে এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল
৩৪টি এক আসনবিশিষ্ট, ১৮০টি দুই আসন ও ৮০টি চার আসনবিশিষ্ট জহুরুল হক হলের ধারণক্ষমতা ৭২৫ জন। কিন্তু হলে থাকেন অন্তত ১ হাজার ২১ জন। প্রশাসনিক হিসাবেই দ্বৈতাবাসিকসহ এর চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী থাকার কথা ছিল।
হলের এক শয্যাবিশিষ্ট কক্ষগুলোতে একজন করেই থাকেন। তবে এগুলোর ৯৪ শতাংশ অছাত্রদের দখলে। মন্ত্রীপাড়া হিসেবে পরিচিত এই ব্লকের শুধু ২১৪ ও ২১৭ নম্বর কক্ষে নিয়মিত ছাত্র থাকেন। তবে তাঁরাও হলের আবাসিক ছাত্র নন।
হলের মূল ভবনজুড়ে বাকিগুলো দুই শয্যার কক্ষ। এমন ১৮০টি কক্ষের ১২৬টিতে ১৯১ জন অছাত্র থাকেন। প্রতি কক্ষেই আছেন তিন বা চারজন করে। এর মধ্যে ৫০-৬০ জন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বাকিরা এঁদের মদদেই হলে থাকেন।
দুজনের কক্ষে একা থাকেন পাঁচজন ছাত্রলীগ নেতা। এর বাইরে বর্ধিত ও টিনশেড ভবনের চার আসনবিশিষ্ট ৮০টি কক্ষে থাকতে হচ্ছে ৫৭৪ জনকে। ভবন দুটোতে পাঁচটি গণরুমের প্রতিটিতে ৪০ থেকে ৪৫ জন করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী থাকেন।
হলের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগের সাবেক উপ-কৃষিবিষয়ক সম্পাদক সাকলাইন থাকেন ২০৮ নম্বর কক্ষে। একই শিক্ষাবর্ষের মিজানুর রহমান থাকেন ২০৯ নম্বর কক্ষে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র মাহবুবুর রহমানের মাস্টার্স শেষ হয়েছে ২০১১ সালে। এখন একটি টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরিও করছেন তিনি। কিন্তু এখনো থাকছেন হলের ৩৪০ নম্বর কক্ষে। ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কেন হলে থাকছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ ছাড়া ৩১১, ৩১২, ৩১৪ ও ৩১৭ নম্বর কক্ষে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকেন। এঁরা সবাই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিফাত জামান ও সাধারণ সম্পাদক আল নাহিয়ান খানেরও ছাত্রত্ব শেষ।
হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল নাহিয়ান খান বলেন, ‘হল প্রশাসন আমাদের যেভাবে রাখবে, আমরা সেভাবেই থাকব। প্রশাসন আমাদের হল ছাড়ার বিষয়ে কিছু বলেনি। তাঁরা যা বলবেন, আমরা তা-ই শুনব।’
ছয় বছর ধরে হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন। এর আগে ১০ বছর এই হলেরই আবাসিক শিক্ষক ছিলেন তিনি। অছাত্রদের হলে থাকার বিষয়টিকে তিনি একটি সংকট বলে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘সমস্যা উত্তরণে আমাদের নানা উদ্যোগ রয়েছে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ তবে ছয় বছরে সফলতা কতটুকু, সে বিষয়ে তিনি কোনো স্পষ্ট জবাব দেননি।
অমর একুশে হল
হলের ১৫৫টি কক্ষের সব কটিই চার আসনের। ২০১ নম্বর কক্ষে একাই থাকেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মইনুল ইসলাম। তিনি ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। একটি সরকারি ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি করছেন। চারজনের কক্ষ একাই দখল করে থাকার এমন নজির অবশ্য তিনি একা নন। অন্তত ১৭টি কক্ষে যেখানে মোট ৬৮ জন ছাত্র থাকার কথা, সেখানে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের মাত্র ১৭ জন নেতা থাকেন।
একুশে হল শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুজ্জামান বলেন, ‘ছয়-সাতটা রুম আছে, ‘যেখানে সাবেক কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্য থাকেন। আমি ওঁদের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি। আমি নিজেও একা থাকি না, দুজন থাকি।’ তিনি ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের। মাস্টার্স শেষ করার পর আবারও একটি মাস্টার্স করছেন বলে জানান।
একুশে হল ৬২০ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হলেও বাকি ১৩৮টি কক্ষে অন্তত ১ হাজার বাসিন্দা রয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৪৪টি কক্ষে ৯৮ জন অছাত্র থাকেন। এই হলের আটটি গণরুমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের ১৫২ জন ছাত্র থাকেন।
হলের প্রাধ্যক্ষ মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু অছাত্র আছে। আমরা চেষ্টা করছি একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসার।’ গণরুমের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার প্রাধ্যক্ষ জীবনের এখন পর্যন্ত ব্যর্থতা হচ্ছে এই গণরুম-সংকটের নিরসন করতে না পারা। আমি শেষ দিন পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে যাব। আর এই সমস্যা সৃষ্টির পেছনে কাউকেই আমি ছাড় দেব না।’
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল
৫৪০ জনের জন্য নির্মিত হলটিতে থাকেন অন্তত ১ হাজার ৪৪০ জন। হলের ৩৮৮টি কক্ষের ২৫৪টিই একক শয্যার কক্ষ। এগুলোর বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতাদের দখলে, যাঁদের ৯৬ জনই অছাত্র। ১২৫টি দুই শয্যার কক্ষের ৭৫টিতে প্রায় ১৪৪ জন অছাত্র থাকেন।
হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাকসুদ রানা থাকেন ৪৩৭ নম্বর কক্ষে। যেটি দুজনের জন্য বরাদ্দ হওয়ার কথা ছিল। সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান থাকেন ৩৫৭ নম্বর কক্ষে। তবে পাশের কক্ষটিও (৩৫৬) তিনি দীর্ঘদিন তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
এ ছাড়া দুই শয্যার কক্ষগুলোর মধ্যে আরও অন্তত ২৪টি কক্ষে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা একা থাকেন। এ ছাড়া বাকিগুলোর বেশির ভাগেই চারজন করে থাকেন। আর চারজনের কক্ষগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে গণরুম হিসেবে। মোট নয়টি গণরুমে প্রথম বর্ষের প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী থাকেন।
হলের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ হিসেবে ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ইমতিয়াজ বুলবুল ১১১ নম্বর কক্ষে, ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের আল আমিন, আপেল মাহমুদ ও গোলাম রসুল এখনো হলে থাকেন।
ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় উপ স্কুল ছাত্র বৃত্তি-বিষয়ক সম্পাদক ইমতিয়াজ। জানতে চাইলে তিনি তাঁর শিক্ষাবর্ষের আরও অনেকেই এখনো এই হলে আছে বলে জানান। তবে তিনি নিজের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নিজ হলে অছাত্র থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘সাত-আট মাস হলো দায়িত্ব নিয়েছি। ১০ বছর ধরে এই হলে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। এই হলে অছাত্রদের সংখ্যা অনেক বেশি। সবকিছুই নিয়মের বাইরে চলছে। আমি এ থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছি।’
ফজলুল হক মুসলিম হল
মোট কক্ষ ২৪৪টি। ৭৬৬ আসনবিশিষ্ট হলটিতে থাকেন ১ হাজার ৯০ জন। একক ১৮টি কক্ষের পাঁচটিতে অছাত্ররা থাকেন।
মূল ভবনের দুই শয্যাবিশিষ্ট ১৫২টি কক্ষের ৩৪টিতে একজন করে অছাত্র থাকেন। ৩৩টি কক্ষে থাকে ৫২ জন অছাত্র। বাকি কক্ষগুলোতে ছাত্ররা থাকেন।
বর্ধিত ভবনের দুটি গণরুমেই (২০০৫ ও ৪০১৯) থাকেন ১০২ জন। বর্ধিত ভবনের কক্ষগুলো চার শয্যাবিশিষ্ট হলেও হল প্রশাসনের দাবি, এগুলো ছয় শয্যার। সব কটিতেই আট বা তার বেশি ছাত্র থাকেন।
ফজলুল হক হলের ৩৪৫ নম্বর দুই শয্যার কক্ষে একা থাকেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। গণিত বিভাগে ২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন। নয় বছর আগে তাঁর পড়াশোনা শেষ। তারপরও থাকেন। জানতে চাইলে তিনি হলের কক্ষ ছেড়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন। তবে, গতকালও হলের ছাত্ররা নিশ্চিত করেছেন, তিনি হলেই রয়েছেন।
স্যার এ এফ রহমান হল
এই হলের ১০৪টি কক্ষে ৪১০ জন থাকার কথা। কিন্তু এখানে থাকেন অন্তত ১ হাজার ২২ জন। ৯৪টি কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন ৪৯ জন বহিরাগত ও ১৮৬ জন অছাত্র। ছাত্রলীগের বিভিন্ন পক্ষের মাধ্যমে ১০৩, ১০৮, ১১০ ও ১১১ নম্বর গণরুমে প্রথম বর্ষের প্রায় দেড় শ ছাত্র থাকেন।
হলের ৫০৪ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা মাকসুদ রহমান, শাহেদুজ্জামান ৩০৬ নম্বর কক্ষে এবং জালাল আহমেদ ৪০৭ নম্বর কক্ষে, জাহাঙ্গীর আলম ২০৬ নম্বর কক্ষে থাকেন। এঁরা তিনজনই ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি মনোয়ার হোসেনও হলের জ্যেষ্ঠতম ছাত্রদের একজন।
স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ মো. আফতাব উদ্দিনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে কক্ষের তালিকা চান এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।
জগন্নাথ হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় হল জগন্নাথ। সংখ্যালঘুদের জন্য নির্মিত এই হলের মোট চারটি ভবনে চার শয্যার ২৮৩টি কক্ষ, তিন শয্যার ১৫টি, দুই শয্যার ৭০টি এবং এক শয্যার ১৬০টি কক্ষে মোট ১ হাজার ৪৭৭টি আসন রয়েছে। হলটিতে কতসংখ্যক অছাত্র থাকেন, তার কোনো হিসাব বের করা সম্ভব হয়নি। তবে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, এই সংখ্যা অন্য যেকোনো হলের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
শিক্ষার্থীরা বলেন, এই হলের গোবিন্দ চন্দ্র দেব ভবনের ১৬০টি এক শয্যা কক্ষের মাত্র ১২টিতে ছাত্র রয়েছেন। বাকি সব কটি কক্ষেই অছাত্র রয়েছেন। কিছু কিছু কক্ষে থাকেন বহিরাগত ব্যক্তিরাও। ভবনের ২৪ নম্বর কক্ষে এক কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে থাকেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসান ওরফে সুইম। হলের ছাত্র সৈকত সেন গুপ্ত বলেন, হলজুড়ে অছাত্ররা রয়েছেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় তাঁদের সংখ্যাই যেন বেশি। এঁদের কারণেই সাধারণ ছাত্ররা কক্ষে উঠতে পারেন না। হল প্রশাসনের যেন এদিকে কোনো খেয়ালই নেই।
জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক অসীম সরকারও স্বীকার করেন, হলে অছাত্র ও বহিরাগত আছেন। তবে আগের তুলনায় কম। তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বহিরাগতকে ধরে পুলিশে দিই। চালান করে দিতে বলি। পরদিন শুনি, ছেড়ে দিয়েছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দায়িত্বটুকু পালন না করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না।’ প্রথম আলো
মন্তব্য চালু নেই