ঢাকা কালো পতাকার শহরে পরিণত
আজ অগ্নিঝরা মার্চের দশম দিন। একাত্তর সালের আরও একটি উত্তাল দিন। অগ্নিগর্ভ বিক্ষুব্ধ বাংলায় বিক্ষোভের তরঙ্গ প্রবহমান ছিল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কোর্ট, কাছারি, অফিস-আদালত ছিল বন্ধ। সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি চলছে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি।
পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানেও। আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতে পেরে পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো তাদের সুর পাল্টে ফেলে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে চাপ দিয়ে নিবন্ধ প্রকাশ করে। ইংরেজী দৈনিক ‘ দি পিপল’ পত্রিকায় সেদিন ভুট্টোর কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়েছিল। সেখানে অতিসত্বর জনপ্রতিনিধিদের কাছে শাসনভার বুঝিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
১৯৭১-এর এই দিন ছিল বুধবার। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ মার্চে সূচিত পূর্ব ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ের তৃতীয় দিবস। সর্বাত্মক অসহযোগে কার্যত পুরো দেশ অচল হয়ে পড়েছিল।
এদিন রাজধানী ঢাকায় সকল সরকারী আধা-সরকারী বিভাগের কর্মচারী অফিসে যোগদানে বিরত থাকেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বেসরকারী অফিস, ব্যবসা কেন্দ্র, স্টেট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং সরকারী ট্রেজারিসহ বিভিন্ন ব্যাংক খোলা থাকে।
স্বাধিকার আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে ঢাকা নগরীর সকল বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, সরকারী অফিস, বাসভবন এমনকি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবন এবং রাজারবাগ এলাকায় অবস্থিত পুলিশ বিভাগের অফিসগুলোর শীর্ষেও কালো পতাকা উত্তোলিত ছিল। নগরীর বিভিন্ন সড়কে সকল প্রকার যানবাহনের সম্মুখে শোকের স্মারক কালো পতাকা ছিল। পুরো ঢাকা নগরী যেন কালো পতাকার শহরে পরিণত হয়েছিল।
এদিন নারায়ণগঞ্জের সাব জেলের ২২৩ জন কয়েদী পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। বিগত ৩ ও ৪ মার্চে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে যারা আহত হয়েছিল আজ তাদের মধ্যে এক কিশোর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সারাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশবাসীকে ওয়াকিবহাল করার অভিপ্রায়ে বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি প্রদান করেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই আজ শেষ কথা। বাংলাদেশের জনগণের নামে আমরা যে নির্দেশ দিয়েছি সেক্রেটারিয়েটসহ সরকারী ও আধা-সরকারী অফিস-আদালত, রেলওয়ে, স্থল এবং নৌবন্দরসমূহে তা পালিত হচ্ছে। যারা মনে করেছিলেন, শক্তির দাপটে আমাদের ওপর তাদের মত চাপিয়ে দেবেন বিশ্বের কাছে আজ তাদের চেহারা নগ্নভাবে ধরা পড়েছে। বিশ্ব জনমতের কাছে তারা বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর শক্তির নগ্ন প্রয়োগের যৌক্তিকতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন। এতদসত্ত্বেও বিবেকবর্জিত সেই গণবিরোধী শক্তি তাদের সশস্ত্র পথই অনুসরণ করে চলেছে। তাদের সমর সজ্জা সমানে অব্যাহত।’
এদিকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান ও তাহরিখ-ই-ইশতিকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান এদিন করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। এদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনবার দেখা করেন এবং উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একান্তে আলোচনা করেন।
ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবের ওপর কোনরূপ দোষ দেবার আমি কোন কারণ দেখি না। তিনি সঠিক এবং ন্যায্য ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ছাড়া তার পক্ষে অন্য কোন ভূমিকা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমি তার এ অবস্থানকে সমর্থন করি।’ বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচীর প্রতি আসগর খানের সমর্থনসূচক উক্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দও তাদের মনোভাব প্রকাশ করতে শুরু করেন। ন্যাপপ্রধান ওয়ালী খান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আগামী ১৩ মার্চ ঢাকা আসার ঘোষণা দেন।
একই দলের নেতা মীর গাউশ বখস বেজেঞ্জো জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৪টি শর্ত মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বিবৃতিতে বলেন, ‘শেখ মুজিবের প্রস্তাবসমূহ শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই নয় বরং সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষারও প্রতিফলন ঘটেছে।
অপরদিকে কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি মিয়া মোহাম্মদ খান দৌলতানা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একতরফা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, প্রেসিডেন্টকে তা শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করে দূর করতে হবে। তাছাড়া সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্রুত ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হবে।’
পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এদিন ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৪টি শর্ত মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। অপরদিকে ঢাকায় ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর) সহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবীদের সংগঠনসমূহ অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে মিলিত হতে থাকে। যেন এটাই বাঙালীর ঠিকানা।
এদিন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেন এবং তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার সিদ্ধান্তেই অফিস আদালত চালানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
মন্তব্য চালু নেই