জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি
জাতীয় নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ভোটের রাজনীতি ততই দৃশ্যমান হচ্ছে। ইতোমধ্যেই নিজেদের সমর্থক ও ভোট ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামপন্থি দলগুলোর সমর্থকদের ভোট কাড়তে বড় দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ভোট রাজনীতি অনেকটাই সামনে চলে এসেছে।
এবার ভোটের হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করেছে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাও। সে ক্ষেত্রে বড় দুই দলের সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবেই এই অঙ্ক কষছে ইসলামী দলগুলো। সে পথ ধরেই অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন করে রাজনৈতিক দলে রূপ নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে জোট গঠনের চিন্তাভাবনাও চলছে।
এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনে এক ধরনের দর কষাকষির পথও তৈরি করছে দলগুলো। গোপনে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে।
যদিও ইসলামী দলগুলো নিজেদের গুরুত্ব বোঝাতে মোট ভোটের ২২-২৬ শতাংশ নিজেদের হাতে রয়েছে বলে দাবি করেছে; কিন্তু নির্বাচন বিশ্লেষকরা ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
তাদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর হাতে ৩-৪ শতাংশ ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর হাতে সর্বসাকুল্যে ১-২ শতাংশ ভোট থাকতে পারে। বিশ্লেষকরা এমনও বলেছেন, এমনিতেই আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোটের প্রভাব খুব বেশি পড়বে বলে মনে হয় না। তবে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি প্রশ্রয় পেলে ভোটে প্রভাব পড়তে পারে।
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের জন্য হঠাৎ করেই বড় ফ্যাক্টর করে তোলা হয়েছে হেফাজতে ইসলামকে। ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ইসলাম ও রাসুলকে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি দাবি করে সংগঠনটি আন্দোলন ও সমাবেশের নামে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এরপরই রাজনৈতিক দলগুলো ইসলামভিত্তিক এই সংগঠনটির সমর্থন পাওয়া নিয়ে টানাটানি শুরু করে।
যদিও সে সময় সংগঠনের কর্মসূচিতে বিএনপি-জামায়াত সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের পেক্ষাপটে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় ও সে সুযোগ নেয় আওয়ামী লীগ। দূরত্ব কমিয়ে আনে সরকারের সঙ্গে। চলতি মাসে গণভবনে কওমি মাদরাসার আলেমদের সঙ্গে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসের সনদকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এর আগে তাদের দাবি অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও নববর্ষ অনুষ্ঠানে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। সর্বশেষ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য সরানোর দাবির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে সরকার। এ নিয়ে অবশ্য বেশ সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাদের।
সে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সখ্যেরও অভিযোগ ওঠে। অবশ্য সরকার এটিকে ‘রাজনৈতিক কৌশল’ বলে দাবি করেছে। তবে এর মধ্য দিয়েই প্রথম ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোট রাজনীতি সামনে চলে আসে।
সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বসে নেই হেফাজতে ইসলাম। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংগঠনটিকে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরের কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও সংগঠনের এক নেতা তাদের ‘রাজনীতিতে আসার কোনো পরিকল্পনা নেই’ বলে দাবি করেছেন।
কিন্তু সূত্রগুলো বলেছে, হেফাজতে ইসলামের ভেতর কয়েক ধরনের নেতৃত্ব রয়েছে। এই নেতৃত্বের একটি বড় অংশ বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরাই হেফাজতকে রাজনৈতিক দলে রূপ দিতে চাচ্ছেন। তারা নির্বাচন কমিশনেও (ইসি) গিয়েছিলেন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে খোঁজ-খবর নিতে।
দলীয় সূত্রগুলো আরো বলছে, দলটি অল্প সময়ের মধ্যে সরকার ও বিরোধী শিবিরে নিজেদের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে এবার ভোটের রাজনীতিতে অগ্রসর হচ্ছে। বিভিন্ন মহল হেফাজতকে রাজনীতিতে আনতে নেপথ্যে আওয়ামী লীগের ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করেছে। তাদের মতে, ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোটের চেয়ে নির্বাচনী মাঠে সমর্থনকে বড় করে দেখছে দলটি।
এমনও শোনা যাচ্ছে, হেফাজতের মাধ্যমে বিএনপির জোটভুক্ত অন্যান্য ইসলামপন্থি দলগুলোর সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও চলছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে সুফীবাদী তরীকত ফেডারেশন ছাড়া কোনো ইসলামী দল নেই।
জোটের বাইরে ইসলামপন্থি দলগুলোর সমর্থন আদায়ে বসে নেই বিএনপিও। দলের নীতি-নির্ধারণী সূত্রমতে, ইসলামী ঐক্যজোট (একাংশ) খেলাফতে মজলিস, জমিয়তে উলামা ইসলাম ও খেলাফত আন্দোলনসহ জোটভুক্ত ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে। ভোটের মাঠে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনও আগের মতো। তবে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কের কিছু অবনতি হলেও সেটা পূরণের চেষ্টা চলছে।
এ ব্যাপারে বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আসা ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, ইসলামী দলগুলোর আলেম-ওলামাদের নিয়ে সারাদেশেই একটা ভোট ব্যাংক আছে। নির্বাচনে বড় দলগুলোর সেই ভোট দরকার হয়ে পড়ে। সেজন্য গুরুত্বও বাড়ে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়া যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী এখনো বিএনপি জোটে রয়েছে। এই জোটের অন্য ইসলামী দলগুলো হচ্ছে খেলাফত মজলিস, ইসলামিক পার্টি ও মুসলিম লীগ। দেড় বছর আগে বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আবদুল লতিফ নেজামী নেজামে ইসলাম পার্টি গড়েন। ২০ দলীয় জোটের শক্তি খর্ব করতে আওয়ামী লীগের মদদেই নেজামীরা আলাদা হয়েছেন বলে দাবি করে আসছেন বিএনপি নেতারা। এখন সেই নেজামীই নতুন একটি মোর্চা গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছে।
চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আটরশির পীরের নেতৃত্বাধীন জাকের পার্টি, খেলাফত আন্দোলনের মতো ইসলামী দলগুলো এখনো কোনো জোটে নেই। তবে দলের সূত্রগুলো বলছে, ভোটের রাজনীতিতে পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দলগুলো।
ইসলামী দলগুলোর ভোট টানতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেই মুহম্মদ এরশাদ ৩৪টি দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তবে এই দলগুলোর কোনো সক্রিয়তা বা পরিচিতি নেই। এ ব্যাপারে পার্টির কো-চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, এটি নির্বাচনী উদ্যোগ। সব রাজনৈতিক দলের মতো জাতীয় পার্টিও নিজেদের গোছাচ্ছে।
অবশ্য বড় দুই দলের সুদৃষ্টি ও আগ্রহের ফলে ইসলামপন্থি দলগুলো ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের ‘বড় ফ্যাক্টর’ হিসেবে দেখছে। ইসলামী দলগুলোর নেতারা নিজেদের হাতে এক-চতুর্থাংশ ভোট থাকার দাবি করেছেন।
তাদের মতে, ইসলামী দলগুলোর হাতে মোট ২২%-২৬% ভোট রয়েছে। বাংলাদেশের মোট ১০ কোটি ভোটারের দুই কোটির বেশি ইসলামী দলগুলোকে ভোট দেন। তবে বিভিন্ন সময় জোটের হয়ে অংশ নেওয়ায় ভোটের সঠিক পরিসংখ্যান মেলেনি। এমনকি নির্বাচন বিশ্লেষকরাও ভিন্নমত দিয়েছেন।
তাদের মতে, জামায়াতে ইসলামীর হাতে ৩-৪ শতাংশ ভোট থাকলেও অন্য ইসলামী দলগুলোর কাছে সর্বসাকুল্যে ১-২ শতাংশের বেশি ভোট নেই। এমনকি বড় দলগুলোর রাজনৈতিক প্রশ্রয় না পেলে নির্বাচনে এসব ইসলামী দল তেমন কোনো প্রভাবও ফেলতে পারবে না বলে মনে করেন তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইসলামী দলগুলো নির্বাচন বা ভোটে কতটা প্রভাব ফেলবে তা নির্ভর করছে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির মাত্রার ওপর। রাজনৈতিক প্রশ্রয় না পেলে ভোটে তেমন প্রভাব ফেলতে পারার কথা নয়।
এই নির্বাচন বিশ্লেষক আরো বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সুনির্দিষ্ট ভোট আছে। যদিও এখন বিপর্যস্ত, কিন্তু সুসংগঠিত দল। সর্বশেষও ৩-৪ শতাংশ ভোট ছিল। অন্যগুলোর ভোটচিত্র স্পষ্ট নয়। তবে এটা ঠিক যে আমাদের রাজনীতি ক্রমাগতভাবে ধর্মাশ্রয়ী হচ্ছে। দলগুলো যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসতে চায়। এবার ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি যদি বাড়ে, ধর্মকে যদি রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয়, তা হলে ইসলামী দলগুলো ফ্যাক্টর হতে পারে। ভোটেও প্রভাব পড়তে পারে।
মন্তব্য চালু নেই