জাতীয় ঐক্য প্রশ্নে জামায়াত নিয়ে দ্বিধায় খালেদা

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে ২০ দলের প্রধানতম শরিক জামায়াতকে নিয়ে নতুন করে ভাবছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তবে জামায়াতকে বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য আশা করছেন তিনি। কারণ বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করলেই আওয়ামী লীগ তাদের লুফে নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যদি নিশ্চিত করে যে, ভবিষ্যতে জামায়াতের সঙ্গে তারাও কোনো সম্পর্কে জড়াবে না তবেই বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করবে।

সম্প্রতি গুলশানের নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভাবেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।

সাম্প্রতিক গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পর জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করেন খালেদা জিয়া। খালেদার আহ্বানকে অনেক দল ও ব্যক্তি স্বাগত জানালেও জামায়াতের সঙ্গে তার জোটগত সম্পর্কের বিষয়টিকে ঐক্যের পক্ষে অন্তরায় বলে জানিয়েছেন। ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যের পক্ষে কার্যত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দলীয় জোটের প্রধানতম শরিক ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলাম। জাতির এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে জাতীয় স্বার্থে অনেকে খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের অনুরোধ জানিয়েছেন। এমনকি খোদ বিএনপি ঘরানার অনেক বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্নের পরামর্শ দিয়েছেন খালেদা জিয়াকে।

এ অবস্থায় গত বুধবার (১৩ জুলাই) গুলশানের নিজ রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ওই মতবিনিময় সভায় মিলিত হন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখানে তিনি তার অবস্থান স্পষ্ট করেন।

বৈঠকসূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের অন্য রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের আহ্বান সত্ত্বেও বিএনপি চেয়ারপারসন এই মুহূর্তে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পক্ষপাতী নন। তিনি মনে করেন ২০ দল থেকে জামায়াতকে বাদ দিলে আওয়ামী লীগ যে তাদেরকে লুফে নেবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া জামায়াতকে বাদ দিয়ে নয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সবাইকে নিয়েই সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় প্ল্যাটফর্ম গঠন করতে চান খালেদা।

বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা যেকোনো মূল্যে সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন করতে চায়। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছে বিএনপি। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াত যদি ‘প্রধান প্রতিবন্ধকতা’ হিসেবে দেখা দেয় এবং আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই দলটিকে সঙ্গে না নেয়ার গ্যারান্টি দেয়, তাহলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপি প্রয়োজনে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।

রাজধানীর গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানোর পর ২০ দলীয় জোট, বিএনপির সিনিয়র নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন খালেদা জিয়া।

বৈঠকে উপস্থিত নেতারা জানায়, ২০ দলীয় জোটের ওই বৈঠকে উগ্রবাদ প্রতিরোধে খালেদা জিয়ার জাতীয় ঐক্যের আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে সমর্থন জানানো হয়। জোটের কয়েকজন নেতা ঐক্যের পরিসর বৃদ্ধিতে ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা অন্য দলগুলো বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। তারা অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এবং কারাগারে থাকা মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেন।

ওই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে খালেদা জিয়া তখন বলেন, ‘আমরা অনেক আগেই তাদেরকে আসার (বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত হওয়া) আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা জামায়াতকে বাদ দেয়ার কথা বলে। আমরা সকলকে নিয়েই সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠন করতে চাই। সুতরাং তাদের সঙ্গেও অবশ্যই যোগাযোগ করা যেতে পারে। কিন্তু তারা কি আসবে?’

২০ দলীয় জোটের ওই বৈঠকে জামায়াতের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, ‘সারা দেশের ভোট, সাংগঠনিক ভিত্তি ও জনপ্রিয়তা বিবেচনায় ওই দলগুলোর সম্মিলিত শক্তির চেয়েও জামায়াত অনেক বেশি শক্তিশালী।’

জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আজকে দেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। মানুষ একইসঙ্গে নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কিত। এ অবস্থার উত্তরণে জনগণকে সচেতন করতে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ভোটের দিক থেকে ওই দলগুলো ততটা শক্তিশালী না হলেও দেশে-বিদেশে তাদের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। দেশবাসীর কাছেও রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। একইসঙ্গে তারা পজিটিভ ইমেজসম্পন্নও।’

তবে এ আলোচনা বেশিদূর অগ্রসর না হয়ে সেখানেই শেষ হয়ে যায় বলে বৈঠক সূত্র জানায়।

গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্ট ও বেকারিতে হামলা চালিয়ে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যার পর জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে দল-মত নির্বিশেষ সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে সরকারকে আহ্বান জানান খালেদা।

তবে সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার জন্য জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে এবং দলটিকে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য খালেদা জিয়াকে দায়ী করে তার ঐক্যের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আজকে জামায়াত আমাদের সঙ্গে থাকায় আওয়ামী লীগ নানা কথা বলছে। সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্য গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াতকে প্রতিবন্ধকতা দেখিয়ে জোট থেকে বাদ দেয়ার শর্ত দিচ্ছে। অথচ এই জামায়াতে ইসলামী ছিয়ানব্বই সালে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছে। রাজশাহীতে আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘জামায়াতের পক্ষ থেকে আজকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো কথাই বলা হচ্ছে না, যা বলার বিএনপিই বলছে। এ বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। জামায়াত যে এক সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ছিল, এ বিষয় নিয়ে তাদের কথা বলা দরকার।’

খালেদা জিয়ার এ বক্তব্যের পর জামায়াতের প্রতিনিধি আব্দুল হালিম চুপ করে থাকেন বলে বৈঠক সূত্র জানায়।

এদিকে, গত বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) বিশিষ্ট নাগরিক ও পেশাজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ছাড়তে খালেদা জিয়াকে আহ্বান জানানো হয়। বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘উনাকে (খালেদা জিয়া) জামায়াত ছাড়তে বলেছি। এখন এর বেশি কিছু বলব না।’

বৈঠকে জামায়াতের বিষয়টা উঠেছে জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বলেছি, জামায়াতের পিতৃপুরুষেরা যে অন্যায় করেছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তার জন্য তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘জামায়াতে বর্তমানে যারা আছে, আমার পরামর্শ হলো-তাদের দলীয়ভাবে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তারা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ বিশ্বাস করে, সেটা পুনরায় উল্লেখ করবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কবর জিয়ারত করবে।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোভাব কী বুঝলেন- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, উনিও মনে করেন এটি (জামায়াতে ইসলামীর ক্ষমা চাওয়া) যুক্তিসঙ্গত।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচার হচ্ছে। অনেকের সাজা কার্যকরও হয়েছে। বিএনপিসহ কেউ এর বিরোধিতা করেনি।’

এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হলেও জাতীয় সংসদে এই সরকারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তারা কত আইন পাশ করছে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের আইন পাশ করলেই পারে। তাহলে বিএনপি জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়ার প্রশ্ন আর আসবে না। এ নিয়ে আর বিতর্কও থাকবে না।’

গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘জনগণ মনে করে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সরকার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে না। কারণ, এই ইস্যুতে তারা রাজনীতি করতে চায়। সেজন্য জামায়াত ইস্যুকে জিইয়ে রাখতে চায় সরকার।’



মন্তব্য চালু নেই