ছোট মণি নিবাসের ছোট ছোট কষ্ট
‘আপনারা একটু মোটা মোটা অক্ষরে লিখবেন, ছোট মণি নিবাসে একজনও বাবুর্চি নেই। তাহলে নিবাসের বাসিন্দা শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী ছোট মণিরাই কি নিজেদের রান্না করবে? ’
এ প্রশ্ন রাখেন রাজধানীর আজিমপুরের ছোট মণি নিবাসের একজন কর্মী। নাম প্রকাশ করেননি তিনি। বলেন, সোনামণিরা অসুস্থ হলে তাদের জন্য নেই কোনো চিকিৎসক। কমপাউন্ডারের পদও খালি। ছোট ছোট পা দিয়ে এই সোনামণিরা যেকোনো সময় গেটের বাইরে চলে যেতে পারে। তবে তা দেখভালের জন্যও নেই কোনো রক্ষী বা দারোয়ান। নৈশপ্রহরীর পদও খালি। কয়েক দিন বয়সী নবজাতকদের প্রস্রাব পায়খানার কাঁথা ধোয়ারও লোক মেলে না সবসময়। কারণ আয়াদের রান্নার কাজেও সহযোগিতা করতে হয়।
১৯৬২ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এই ছোট মণি নিবাসের যাত্রা শুরু। বর্তমানে নিবাসে বিভিন্ন বয়সের ৩৫ জন শিশুর বাস। এরা অনেকে হারিয়ে যাওয়া শিশু। অনেকের মা জন্মের পর তাকে ফেলে চলে গেছে। আবার কেউ কেউ চুরি যাওয়ার পর উদ্ধার হওয়া শিশু।
গত মঙ্গলবার দুপুরে নিবাসে গেলে দেখা যায় ঠিকানাহীন এসব শিশুর ছোট ছোটা কাণ্ড। বোঝা যায় ছোট ছোট কষ্ট, যে কষ্টের কথা তারা বলতে পারে না। সেদিন নিবাসের দুই নবজাতক (পরের দিন একজন মারা যায়) ছিল রাজধানীর দুই হাসপাতালে। আয়াদের দুই জায়গায় পালা করে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে নিবাসে শিশুদের দেখভাল করার ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। শিশুদের সবার মাথার চুল ন্যাড়া করা। লিকলিকে শরীর। বেশির ভাগের খালি গা। যাদের গায়ে জামা আছে, তাদেরটাও ছেঁড়া ন্যাতন্যাতে। খালি পা। কয়েকজনের জলবসন্ত হয়েছে। অন্যদের শরীরও খসখসে, মশার কামড়ের চিহ্ন। লম্বা বিছানায় শুধু রাবার ক্লথ বিছানো। সেখানে কেউ কেউ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। খেলতে খেলতে কেউ ঘুমন্ত সঙ্গীর ওপরই পড়ে যাচ্ছে। মারামারি, হুটোপুটি করতে গিয়ে একজনের ডান হাত ভেঙেছে। একটি টেলিভিশনে গুরুগম্ভীর একটি অনুষ্ঠান চলছে, তাতে শিশুদের কোনো মনোযোগ নেই।
পুরো ঘরের মধ্যে গুমোট পরিবেশ। প্রস্রাবের কটু গন্ধও আছে। একজন খালাম্মা (বাচ্চাদের দেখভালকারী) শিশুদের রান্না নিয়ে ব্যস্ত। বারান্দায় বেশ কয়েকটি পটি (প্রস্রাব পায়খানা করার জন্য) পড়ে আছে। শৌচাগারের পানি গণ্ডি পেরিয়ে চলে এসেছে বারান্দায়। দুজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মধ্যে সেদিন একজনও আসেননি।
ছোট্ট নওরিনের সকাল থেকে অনেক জ্বর ছিল। প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়েছে শিশুটি।আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাঁচ মাস বয়সী শুকতারা দুই দিন আগেই হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। তার লিকলিকে শরীরে ক্লান্তির ছাপ।
নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক সেলিনা আক্তার একবার একজনকে কোলে নিয়ে কান্না থামাচ্ছেন তো আরেকজন কান্না জুড়ে দিচ্ছে। কারও কারও প্রস্রাবের কাঁথা পরিবর্তন করতে করতেই আরেকজন প্রস্রাব করে দিচ্ছে। যখন একেবারেই সামলাতে পারছেন না, তখন কারও কারও নাম ধরে বলছেন, তুমি না লিডার, তুমি না ভালো মেয়ে। বয়সে যারা একটু বড়, তারাও কারও কারও কাঁথা পাল্টে দিচ্ছে বা কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। এত দিনে তারা বুঝে গেছে, এরাই তার আপন, এরাই সব।
সেলিনা আক্তার বলেন, ‘ছোট মণি নিবাস হচ্ছে শিশুদের ফাউন্ডেশন। এখানে একদিন বয়সী নবজাতক থেকে শুরু করে সাত বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী শিশুরা থাকে। ফাউন্ডেশনটা ভালো হলে এরা যেখানে যাবে, সেখানেই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে। এদের মধ্যে যারা একেবারে ছোট, তাদের পেছনে সারাক্ষণই একজন আয়া থাকা প্রয়োজন। তাদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা জরুরি। সার্বক্ষণিক একজন বাবুর্চি থাকা আরও জরুরি। এখন দেখা যাচ্ছে, যে আয়া প্রস্রাব পায়খানার কাঁথা পরিষ্কার করছেন, তিনিই আবার বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন বা রান্না করছেন। এতে এই সোনামণিদের দিকে যথাযথভাবে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
খাদ্য, দুধ ও জ্বালানি বাবদ ছোট মণিদের জন্য জনপ্রতি মাসিক বরাদ্দ দুই হাজার টাকা। শিক্ষা বিনোদনের জন্য বরাদ্দ ১০০ টাকা। পোশাক পরিচ্ছদের জন্য বরাদ্দ ২০০ টাকা। চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ ১৭৫ টাকা ও তেল-সাবানের জন্য রয়েছে ১২৫ টাকা। মোট বরাদ্দ দুই হাজার ৬০০ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন জন বিভিন্ন খাবার ও অন্যান্য অনুদান দিয়ে থাকেন।
গত মঙ্গলবার নিবাসের শিশুদের জন্য পাঁচ কেজি আম নিয়ে দেখতে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা চৌধুরী। তাঁর ভাষ্য, বন্ধুরা প্রায়ই এখানে এসে কেক কেটে একেকজনের জন্মদিন উদ্যাপন করেন। এতে শিশুরা খুব মজা পায়। কেক কাটার সময় তারাও নিজেদের জন্মদিন হচ্ছে বলে মনে করে।
সানজানা চৌধুরীর মতে, এই শিশুদের জন্য অনেকেই খাবার বা অন্য কিছু দিচ্ছেন। তবে এই শিশুদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটু আদর। কাছে টেনে খানিকক্ষণ গল্প করলে তারা খুব খুশি হয়। জানা গেল, নিবাসের আসনসংখ্যা ২৫ থেকে ১০০টি করা হয়েছে। তবে জনবলসহ অন্য কোনো সুযোগসুবিধা বাড়ানো হয়নি। প্রশিক্ষিত জনবলেরও সংকট।
সেলিনা আক্তার বলেন, এখানে শিশুদের জন্য অনেক ধরনের অনুদান পাওয়া যায়। জনপ্রতি বরাদ্দও মন্দ নয়। তবে জনবলের সংকটের কারণে ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। এখানে আসা শিশুদের বেশির ভাগেরই রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা একেবারে কম থাকে। ফলে তারা দ্রুত অসুস্থ হয়। দু-একটা বাচ্চা হাসপাতালে থাকলে তখন কোনোভাবেই সামলানো সম্ভব হয় না। জামা কাপড়, জুতা থাকলেও তা পরানোর লোকের অভাবে শিশুদের দিকে তাকানোর আর উপায় থাকে না।
সমাজসেবা অধিদপ্তর নিবাসের বেশ খানিকটা জায়গা কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য নিয়েছে। এতে যে ঘরে শিশুদের খেলনা রাখা হয়েছে, সেখানে গিয়ে খেলার সুযোগও কমে গেছে। শিশুদের পুরোটা দিন কাটছে একটি ঘরের ভেতর। এতে তাদের ছটফটানিও বেড়েছে।প্রথমআলো
মন্তব্য চালু নেই