ছুটি পাবেন মৃত্যুর ফেরিওয়ালা

১৯৭০ সালের আফগানিস্তান আর ২০১৪ সালের আফগানিস্তানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। পাহাড় ঘেরা যে আফগানিস্তানকে দেখতে একটা সময় পর্যটকরা ভিড় করতো দূর দুরান্ত থেকে, এখন সেই আফগানিস্তানের বাতাসে কড়া কটু কারডাইটের গন্ধ আর লাশের পাহাড়। সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী শাসককে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দেশটিতে তৈরি হলো মুজাহিদিন বহিনী। আবার সেই মুজাহিদিন বাহিনীই পরবর্তীতে তালেবানপন্থী(আদিবাসী গোত্র)আল-কায়েদা বাহিনী হিসেবে আবির্ভূত হলো। আর ওই আলকায়েদাকে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গোটা দেশ এখন মৃত্যুর শীতল অন্ধকারে নিমজ্জিত। তালেবান বনাম আফগান দ্বন্দ্বে দ্বিধাবিভক্ত দেশটির জনগন। পক্ষ অবলম্বন করলেও মৃত্যু, না করলেও মৃত্যু। ঘাতক বুলেট-বোমার আঘাতে মৃত্যু যেন এখানে অনিবার্য নিয়তি। তবু এরই মাঝে কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে বেঁচে আছেন মালিক আবদুল হকিম। মৃত্যু ফেরি করে বেড়ানো হাকিম এখন ছুটি চান এই অনিবার্য নিয়তি থেকে।

তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় মার্কিন বাহিনী কিংবা আফগান বাহিনীর হামলা পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহ সংগ্রহ করাই কাজ আবদুল হাকিমের। আবার তালেবানরা যখন কোনো আফগান সেনা চৌকিতে কিংবা রাস্তায় কোনো সরকারি সেনাকে হত্যা করে তখন সেই মৃতদেহকেও সংগ্রহ করেন হাকিম। আর সেই লাশ সংগ্রহ করার পর লাশকে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে পৌছে দেন তিনি। এই কাজের জন্য অবশ্য হাকিমকে কেউ নিয়োজিত করেনি। নিজের তাগিদে, নিজের মানবিক বোধই তাকে তাড়িত করেছে এই কাজের জন্য।

৬৬ বছর বয়সী হাকিমের চুল-দাড়ি প্রায় সাদা হয়ে গেছে। বুকে ধরেছে ক্ষয়কাশ। তবুও এরই মাঝে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে মৃতদেহ সংগ্রহ করে আনেন তিনি। অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, যুদ্ধের মধ্যে লাশ সংগ্রহ করারই বা কি মানে। কিন্তু হাকিমের কাছে এর মানে অনেক। মানুষের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের পরিজনের আশায় বসে থাকে, সে আহতই হোক আর নিহত হোক। স্বজনেরা নিহত পরিজনের লাশ হাতে পেলে অন্তত কবর দিতে পারবে এই ভেবে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে লাশ টেনে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘ বছর ধরে আবদুল হাকিম খোদার কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছেন এই বলে, যেন তার এই কাজ আর না করতে হয়। খুব দ্রুতই যেন এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ-সংঘাত শেষ হয় এবং তাকে যেন আর লাশের বোঝা টানতে না হয়।

‘প্রত্যেক সময় আমার চোখের সামনে একটি মৃতদেহ ভেসে ওঠে। আর আমি প্রার্থনা করতে থাকি যেন এই দৃশ্য আমাকে আর দেখতে না হয়। এখানে যখন স্থিতিশীলতা আর শান্তি ফিরে আসবে তখনই কেবল আমি শান্তি পাবো, আর আমাকে এই কাজ করতে হবে না।’-আবদুল হাকিম।

মৃত্যুর ফেরিওয়ালাতবে যতদিন পর্যন্ত না দেশে শান্তি ফিরে আসবে না ততদিন পর্যন্ত তিনি এই কাজ করে যাবেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ক্ষত-বিক্ষত লাশের দুর্গন্ধ আর বিকৃত লাশ মানসিক চাপ হয়ে আবদুল হাকিমের শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে প্রতিনিয়ত। তবুও তিনি লাশ সংগ্রহ করেই যাবেন। এমনকি জঙ্গিদের হাতে তার দুই সন্তান নিহত হওয়ার পরেও তিনি একাজ থেকে ফিরে আসেননি। ‘আজ অবধি আমি যা করেছি তা সব খোদার জন্য। আমি আমার দুই পক্ষের ভাইদের কাছেই যেতে পারি। কারণ তারা আফগান এবং মুসলিম। আমার কোনো অবস্থান বা সুযোগ সুবিধার দরকার নেই। আমার একটাই লক্ষ্য, যাদের সাহায্য দরকার তাদের সাহায্য করা।’

আফগানিস্তানের এই দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী বছর ছিল ২০১৪ সাল। তালেবানদের হামলায় যেমন অনেক আফগান নিরাপত্তাকর্মী মারা গেছে, তেমনি আফগান বাহিনীর হামলায়ও অনেক তালেবান যোদ্ধা মারা গেছে। স্রেফ গত বছরই আবদুল হাকিম ৩১৩টি মৃতদেহ কাধে বয়ে নিয়ে গেছেন। তালেবানরা এবং আফগান কর্তৃপক্ষ তাকে কয়েক দফা আটক করে জিজ্ঞসাবাদ করেছিল, কিন্তু তার সঙ্গে কোনো পক্ষের সম্পৃক্ততা না থাকায় তাকে ছেড়ে দেয় তারা। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্দাহার প্রদেশের জাহরে জেলা পুলিশের প্রধান মোহাম্মদ মাসুম খান কাদিরি বলেন, ‘তিনি সবসময়ই নিরপেক্ষ থেকেছেন। তিনি আমাদের বিপক্ষে নয় আবার তালেবানদের বিপক্ষেও নন। তিনি যাদের উপকার করেছেন তারা তাকে খুবই ভালোবাসে।’

গেল বছরের শুরুর দিকে এসমাতুল্লাহ নামের এক ব্যক্তির দুই ভাইকে মৃত অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন হাকিম। তালেবান যোদ্ধাদের হাতে তারা নিহত হয়। নিহত দুই ভাইয়ের ভাই এসমতুল্লাহ জানান, ‘আমার মা প্রথমে তার দুই সন্তানের জন্য কোনো প্রার্থনা করেনি। কিন্তু যখন হাকিম তাদের দেহ এনে দেয় তখন মা প্রথমেই হাকিমের জন্য প্রার্থনা করেন।’

হাকিমের জন্য এই কাজ করা অতটা সহজ ছিল না। প্রথমদিকে তালেবানদের মৃতদেহই তিনি সংগ্রহ করতেন। কিন্তু একদিন আফগান কমান্ডারের সামনে পরলে, সেই কামান্ডার তাকে শুধু তালেবানদের মৃতদেহ সংগ্রহ করার কারণ জিজ্ঞেস করে। হাকিম তখন বলেন যে, সরকারি দেহ বহন করার অনুমতি যদি তার থাকে তাহলে তিনিও তাই করবেন। অবশ্য কমান্ডার এক শর্তে সরকারি দেহ সংগ্রহ করার অনুমতি দেন হাকিমকে। আর তা হলো, তালেবানরাও যেন সরকারি সেনাদের মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তা ছেড়ে দেয়।

এখন অবশ্য হাকিম একাই এই কাজ করেন না। চার বছর আগে তাকে সাহায্যে জন্য এগিয়ে আসে রেডক্রস। এরপর থেকে হেলমন্দ, জাবুল এবং ওরজুগান প্রদেশেও হাকিম তার কাজ শুরু করে। গত গ্রীষ্মে একদিনে হাকিম ২৮জন তালেবানের মৃতদেহ বয়ে নিয়ে আসেন। চোখের সামনে নিজের কওমের মানুষের মৃত্যু দেখতে ভালো লাগে না তার। তার ভাষায়, ‘তারা গত ১৩ বছর ধরে যুদ্ধ করছে। আগামী ১৩ বছর ধরেও যদি তারা যুদ্ধ করে তবুও এখানে শান্তি আসবে না। তাদের অবশ্যই একসঙ্গে বসে সমস্যা সমাধানে আলোচনা করতে হবে।’



মন্তব্য চালু নেই