বিজ্ঞানের নতুন যীশু

চোখের টেলিস্কোপ লেন্স

আমাদের ভেতর অনেকেই আছেন যারা চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পান না। কোনোভাবে চোখ থেকে তা খুলে পড়ে গেলেই হয়েছে, দেখতে থাকেন রঙবেরঙের বৃত্ত। অনেকের চোখের অবস্থা আরও খারাপ। চিকিৎসক ক্রমশ অন্ধত্বের দিকে যাওয়ার জবাব দিয়ে দিয়েছেন। দেখা যায়, শুধুমাত্র বয়সবৃদ্ধির কারণেই অনেকে চোখের ক্ষমতা হারিয়ে এ পথে হাঁটছেন বৈশ্বিক জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ। ঐ সমস্ত মানুষের সহায়তায় বিগত বহুবারের মতো আবারও এগিয়ে এলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা এবার মানুষকে উপহার দিতে চলেছে এমন এক চোখলগ্ন লেন্স, যা দিয়ে কোনো বস্তুর বিম্ব অন্তত তিনগুণ বিবর্ধিত করে দেখা সম্ভব হবে। যার মাধ্যমে স্বল্পদৃষ্টির মানুষেরা পৃথিবী দেখার নতুন স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।

চোখলগ্ন লেন্সের সর্বশেষ অগ্রগতি এতদূর পৌঁছেছে যে মাত্র ১.৫৫ মিলিমিটার পুরুত্বের লেন্সে বসানো সম্ভব হয়েছে একটি আলোক-প্রতিফলনে সক্ষম টেলিস্কোপ এবং ছাঁকন বা ফিল্টার। কোনো বস্তু থেকে আলো ঐ লেন্সে এসে পড়ামাত্রই তা টেলিস্কোপের সূক্ষ্মতর কাচগুলোয় একাধিকবার প্রতিফলিত হয়ে প্রয়োজনীয় রকম বড় বিম্ব ফেলতে পারবে রেটিনার নির্দিষ্ট স্থানে। দর্শক তখন স্পষ্ট দেখতে পাবেন ঐ বস্তুটিকে, চিহ্নিত করতে পারবেন বস্তুর বৈশিষ্ট্য ও ধরতে পারবেন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিবর্তন। যারা বয়োবৃদ্ধিজনিত চোখের হ্রস্বদৃষ্টি বা ম্যাকুলার ডিজেনারেশেনে ভুগছেন, তাদের জন্যে এটা উৎকৃষ্ট দর্শনসহায়িকা, কেননা ম্যাকুলার ডিজেনারেশনে রেটিনার কার্যক্ষমতা ক্রমশ কমতে শুরু করে এবং এ সীমাবদ্ধতার চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি।

এ অভিনব লেন্সের স্বপ্নদ্রষ্টা সুইস গবেষক এরিক ট্রেম্বলি বলেন, ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের মতো রোগে বস্তুর বিবর্ধিত বিম্বই দর্শণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার উৎকৃষ্ট উপায় । ট্রেম্বলি তার একাধিক বয়স্ক রোগীর চোখে এ লেন্স পরিয়ে দেখেছেন, সাধারণ চোখলগ্ন লেন্সের চেয়ে এটা অনেক বেশি কার্যকর।

telescope-lense-collageএ লেন্স পরলে শুধু যে বস্তুর বিবর্ধিত বিম্বই রেটিনায় ছাপ ফেলবে তা কিন্তু নয়। এটি সাধারণ কন্টাক্ট লেন্সের ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হতে পারে। এ লেন্সে সন্নিবেশিত হয়েছে একাধিক প্রকরণের সূক্ষ্ম পরিপূরক কাচ। এর ভেতর স্বয়ংক্রীয় প্রযুক্তিও পশে দেয়া হয়েছে। লিকুইড ক্রিস্টাল ডিস্ক প্রযুক্তি যে উপায়ে কাজ করে, একই উপায়ে কাজ করবে এ লেন্স। ব্যবহারকারী তার প্রয়োজন বুঝে নির্দিষ্টবার চোখের পলক ফেললেই এটি দৃশ্যকে বড় করে দেখাবে। আরেক পলকে আবার ফিরে যাবে সাধারণ দর্শনযোগ্য অবস্থায়। এ বিশেষ সুবিধা ব্যাটারিচালিত এ লেন্সের ব্যবহারকে আরও স্বচ্ছন্দ করেছে।

ট্রেম্বলির চিকিৎসাধীনরা জানিয়েছেন এ লেন্স তাদের ভীষণ উপকারে আসছে কাছে অবস্থানকারী মানুষদের চেনার ক্ষেত্রে, খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে, এমনকি রাস্তা পেরোবার ক্ষেত্রে। কোনো গাড়ি বিপদজনকভাবে এগিয়ে আসছে কিনা, সঠিক মানুষটির সঙ্গে তারা কথা বলছেন কিনা এসব এখন যৌবনের মতোই দেখতে পারছেন তারা। ঠিক কোন বস্তুটিকে ব্যবহারকারী বড় করে দেখতে চাইছেন, তা দৃষ্টিকোণের ওপর নির্ভর করে স্বয়ংক্রীয়ভাবে ঠিক করে দেয় লেন্সটি। কোনো বস্তুর বিম্ব বড় হওয়ার পর অবধারিতভাবে আগের দৃশ্যপরিধির কিছু অংশ কাটা পড়ে। তবে এতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা জানাননি ব্যবহারকারীরা।

এরপরও একে আরও ব্যবহারবান্ধব করার জন্যে গবেষণা চলছে। চোখের সাদা অংশকেও কিছুটা আবৃত করবে- এমন পর্যায়ে লেন্সটি উন্নীত হয়েছে এরইমধ্যে। এর মাধ্যমে যতটা সম্ভব বড় পরিসরে দৃশ্য বড় করে তোলার যান্ত্রিক প্রকৌশল প্রয়োগ করা সহজ হয়েছে। চোখ যেন পর্যাপ্ত অক্সিজেনের সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত না হয়ে পড়ে, সেটিও মাথায় রাখা হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রেম্বলির গবেষকরা যে লেন্স উপস্থাপন করেছেন, তাতে অক্সিজেন পরিবহনের জন্যে পর্যাপ্ত বায়ুনল (এয়ার চ্যানেল) যুক্ত করা হয়েছে। এখানেই তারা থেমে যাচ্ছেন না। লেন্সেই অক্সিজেন জমিয়ে রাখা যায় কিনা সেটাই তাদের এ মুহূর্তের গবেষণার বিষয়বস্তু। এমন ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টা চলছে যেন অক্সিজেন লেন্সেই জমা করে রাখা যায় এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণটি একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর স্বয়ংক্রীয়ভাবে চোখের ত্বকে মুক্ত হতে পারে।

উন্নত বিশ্ব পড়াশোনা ও গবেষণায় কতখানি এগিয়ে আছে এবং অকল্পনীয় গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তার ছোঁয়ামাত্র পাওয়া গেল। এর পাশে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও গবেষণার গতিকে দাঁড় করালে বিব্রত হতে হয় বৈকি।



মন্তব্য চালু নেই