চিঠিতে আত্মহত্যার আগে যা লিখে গেলেন ঢাবির ছাত্রী আনিকা
মা-বাবার দুই সন্তান। তার মধ্যে ছোট। চঞ্চল, মেধাবী তরুণী। আদরের সেই মেয়েটি মাতিয়ে রাখতেন পুরো বাসা। বন্ধুদের মধ্যেও প্রিয়মুখ ছিলেন তিনি। তার নাম আফরা আনিকা মৈত্রী। বন্ধু তার সকল বন্ধন ছিঁড়ে, পৃথিবীর সকল মায়া ত্যাগ করে মৈত্রী এখন না ফেরার দেশে।
এটি স্বাভাবিক কোনো মৃত্যু না। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসার কক্ষ থেকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। কি কারণে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন মৈত্রী প্রশ্নটি স্বজন-সহপাঠীদের মুখে মুখে। মৃত্যুর আগে একটি চিরকুট লিখেছিলেন তিনি। সেই চিরকুট এবং মৃত্যুর আগে তার মোবাইলফোনে আসা কল ও ফেসবুকের ক্ষুদেবার্তার সূত্র ধরে তদন্ত করা হচ্ছে আত্মহত্যার রহস্য।
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চিরকুটে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন মৈত্রী। লিখেছেন, ‘মা-বাবা ক্ষমা করে দিও আমাকে। বেঁচে থাকলে বোনের বিয়েতে অনেক মজা করতাম। দোয়া করি বোন ও বোন জামাই (হবু) আজীবন সুখে থাক। আমি ছোট মানুষ। ছোট মানুষের সঙ্গে রাগ করতে নেই। ছোট মানুষকে ক্ষমা করে দিও…।’
মৈত্রীর কক্ষ থেকে উদ্ধারকরা চিরকুটে মৃত্যুর কোনো কারণ উল্লেখ নেই। তেজগাঁও থানার তেজতুরি বাজার এলাকার ৮১ নম্বর বাড়ির ফ্ল্যাট বাসায় মৈত্রীকে নিয়েই থাকতেন মা-বাবা। বড় মেয়ে আফরা আনান মৃদু মেডিকেলের ছাত্রী। থাকেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের হলে। ঘটনার দিন গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বাসা থেকে বাইরে বের হন মৈত্রীর বাবা চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের (অব.) অধ্যাপক মো. আশরাফ উদ্দিন। তার আগে সকাল থেকেই কর্মস্থলে ছিলেন মৈত্রীর মা তেজগাঁও গার্লস স্কুলে শিক্ষিকা রওশন আরা পারভিন। মাত্র এক ঘণ্টার ব্যবধানে মেয়ের লাশ দেখতে হয়েছে বাবাকে।
অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি যখন বাসা থেকে বের হন তখন মৈত্রীকে পড়তে দেখছেন। দেখে মনে হয়নি তার মন খুব খারাপ ছিল। অধ্যাপক আশরাফ বাসা থেকে বের হওয়ার পর শিশুগৃহকর্মী শিমু ছিল বাসায়। শিমু জানায়, ঘটনার সময় সে বাথরুমে গোসল করছিল। তার আগে মৈত্রীকে পড়তে দেখেছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে মৈত্রীর কক্ষের দরজা বন্ধ দেখতে পায়। এর মধ্যেই কলিংবেলের শব্দ। বাসায় ঢুকেন অধ্যাপক আশরাফ। দরজা বন্ধ দেখে জানতে চান, মৈত্রী কোথায়। শিমু জানান, রুমের ভেতরে। দরজায় নক করেন। মৈত্রীকে ডাকেন, ‘মা দরজা খোল’। এভাবে বারবার ডাকতে থাকেন তিনি। কিন্তু তার আদরের মেয়েটির কোনো সাড়া নেই। বুকটা কেঁপে উঠে অধ্যাপক আশরাফের।
চাবি দিয়ে দ্রুত দরজা খুলে দেখতে পান ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে ঝুলছে মৈত্রী। চিৎকার করে সারা ঘর মাথায় তোলেন তিনি। যেন পুরো পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে। মেয়ের দুই পা উপরে তোলে ধরেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। মৈত্রী পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। খবর পেয়ে ওই দিন বেলা ৩টায় লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে স্বজনদের নিকট লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
বুধবার দুপুরে মৈত্রীর বাসায় গেলে তার মা-বাবা, বোন কাউকে পাওয়া যায়নি। কথা হয় মৈত্রীর চাচাতো বোন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী তমার সঙ্গে। তমা জানান, কেন এই মৃত্যু। এই প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছেন না কেউ। মৈত্রী ছিলেন চঞ্চল, হাসিখুশি ধরনের মেয়ে। এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়তেন।
সূত্রমতে, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে প্রায়ই বিষণ্ন থাকতেন মৈত্রী। গত ১৯শে ডিসেম্বর ফেসবুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওয়েল, দ্যা ওয়ার্ল্ড ডাজ নট টার্ন ইটস ব্রেক অন মি।’ তারপরও বিষণ্নতা উড়িয়ে দিয়ে স্বভাবসুলভ ভাবে আনন্দে মেতে থাকতে চেষ্টা করতেন। গত পয়লা ফাল্গুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র আনবিদ জামানসহ বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতেছিলেন তিনি। ওই দিন হলুদ শাড়ি পরে ক্যাম্পাসে সময় কাটিয়েছেন, ছবি তোলেছেন।
তারপরও কি কারণে মাঝে-মধ্যে বিষণ্ন থাকতেন তার সঠিক কারণ জানা না গেলেও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল মৈত্রীর। বিষয়টি তার বড় বোন আফরা আনান মৃদুসহ অনেকেই জানতেন। সূত্রমতে, প্রায়ই তার সঙ্গে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতো মৈত্রীর। এসব কারণে মন খারাপ থাকলেও আত্মহত্যা করার মতো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে তা ভাবতে পারেন না কেউ।
এ বিষয়ে তেজগাঁও থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক জাকির হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এতে কারও প্ররোচনা আছে কি-না তা আফরার আনিকার চিরকুট, ফোনের কললিস্টের সূত্রধরে তদন্ত করা হচ্ছে। মেডিকেলের এক ছেলে বন্ধু সম্পর্কে জানান, তার সঙ্গে মনোমালিন্য হতে পারে। কিন্তু এজন্য আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি। আফরা আনিকা মৈত্রী নোয়াখালী জেলার সুধারাম উপজেলার মাইজদী কোর্ট এলাকার অধ্যাপক মো. আশরাফ উদ্দিনের মেয়ে। এমজমিন
মন্তব্য চালু নেই