চারিদিকে সংলাপের নানা সুর, নানা শর্ত
চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু দল দুটির নানা শর্তের বেড়াজালে আটকে আছে সংলাপ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল, অবিলম্বে আবারও নির্বাচনের দাবিতে সারা দেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চলছে। এদিকে কর্মসূচি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সরকারও অনড় অবস্থানে রয়েছে। ফলে রাজনীতিতে প্রতিদিনই সহিংসতার নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। আর এ সহিংসতার বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের শর্ত—নাশকতার পথ পরিহার করলেই কেবল সংলাপ। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শর্ত—তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল ও অবিলম্বে নির্বাচনের আশ্বাস দিলেই সংলাপে বসবে বিএনপি। এ উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। তা না হলে লাগাতার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটিয়ে অধিকার আদায় করবে তারা।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আকবর আলী খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সংলাপ নিয়ে নানা মত-পথ থাকলেও দুই-একদিন ধরে সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্য, বিবৃতিতে সংলাপ প্রসঙ্গটি উঠে আসছে। এতে মনে করি, চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে আশার সঞ্চার ঘটছে।’
এর আগে দুই মন্ত্রীর বক্তব্যে সংলাপের ব্যাপারে সরকারের নমনীয় মনোভাব ফুটে উঠেছে। গত সোমবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সংলাপ-আলোচনার কথা বলছেন, তাদের উচিত নাশকতাকারী ও অবরোধ-হরতালের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বোঝানো। এরা (বিএনপি) যদি সন্ত্রাসের পথ থেকে ফিরে আসে। তাহলে হয়ত ওদের সঙ্গে আলোচনা হলেও হতে পারে।’
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি গেটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেন প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ করব, এই সর্বনাশা পথ থেকে বেরিয়ে আসুন। সর্বনাশা পথ থেকে বেরিয়ে এসে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন। দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে আর সরকার অনড় অবস্থানে থাকবে এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই।’
দাবি আদায়ে এ বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি দেওয়ায় নতুন করে সংলাপের প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসছে। গোলটেবিল বৈঠক, সভা-সেমিনারে সুশীল সমাজসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আহ্বান জানিয়েছে সংলাপের।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের দাবিতে গত এক সপ্তাহ ধরে মতিঝিলে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও সংলাপের দাবিতে অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন গত সোমবার। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সরকারকে কয়েক দফায় সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। রাজধানীর কাকরাইলে দলের কার্যালয়ে সম্প্রতি প্রতীকী অনশনও করেন এরশাদ। গত ২৯ জানুয়ারি সংলাপের দাবিতে দুই দলকে চিঠি দেন।
সংলাপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ হয় দ্য রিপোর্টের এ প্রতিবেদকের।
এ সব আলাপে জানা গেছে, সংলাপে রাজি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। তবে দলটির নীতি-নির্ধারণী মহল সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না এলে সংলাপে বসবে না তারা। ক্ষমতাসীন দলের নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত হল—এ মুহূর্তে সংলাপে বসা হলে তা হবে নাশকতার কাছে আত্মসমর্পণ করা।
ওই নেতাদের মতে, পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে গেছে তাতে সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের ডাক দিলে বিএনপি পরের দিনই বিজয় মিছিল করবে। এতে নৈতিক পরাজয় ঘটবে সরকার ও আওয়ামী লীগের। মূল কথা হল—নাশকতার সঙ্গে সংলাপ বা আলোচনা হতে পারে না। রাজনীতির স্বার্থে সংলাপ হতে পারে।
কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, গত কয়েক দিন যাবত প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সংলাপ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোভাব ফুটে উঠেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘সরকার কার সঙ্গে সংলাপে বসবে? নাশকতাকারীদের সঙ্গে?’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে মাত্র। নাশকতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা বা সংলাপ নয়, প্রচলিত আইনেই তাদের দমন করা হবে।’
সভাপতিমণ্ডলীর অপর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘সংলাপ চাইলে বিএনপিকে রাজনীতি করতে হবে, নাশকতা নয়।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশে সংলাপ হতে পারে। নাশকতার মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিএনপি সরকারকে সংলাপে বাধ্য করবে তা হতে পারে না।’
সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির ঢাকা মহানগর কমিটির সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান বলেন, ‘নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তো ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) বিভিন্ন সময়ে সংলাপের কথা বলেছেন। এ বিষয়ে সংলাপের পরিবেশ তৈরি হলে নিশ্চয় বিএনপি সাড়া দেবে।’ দ্য রিপোর্ট
মন্তব্য চালু নেই