ঘূর্ণিঝড় সিডর দিবস : আজো কান্না থামেনি, ৯ বছর ধরে তাদের অপেক্ষা

কামরুজ্জামান শাহীন, ভোলা: সাগরে ট্রলার ডুবেছে, লাশের সন্ধান মেলেনি। তাই কারো প্রতিক্ষা স্বামীর জন্য, কারো বাবা কারো বা ভাই আর সন্তনের। একদিন জীবিত ফিরে আসবেন তাই এ অপেক্ষা তাদের। এভাবে ৯ বছর কেটে গেলেও আজো ফিরে আসেনি কেউ। তবুও তারা ফিরে আসবেন এমন প্রতিক্ষা যেন শেষ হচ্ছে না।

ভোলা সদরের ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে ঘূর্নিঝড় সিডরে নিখোঁজ ৯ জেলে পরিবারে এমন অপেক্ষার প্রহন যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে। ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও সন্ধ্যান মেলেনি সেই ৯ জেলের। অনেক খোজাখুজি করে তাদের লাশও পাওয়া যায়নি। তারা বেচে আছেন নাকি মরে গেছে তা জানেনা কেউ। তবে তাদের পরিবারের সদস্যরা আজো তাদের প্রতিক্ষায় আছেন।

প্রিয়জনের কথা মনে করে কেঁদে উঠেন স্বজনরা। যেন এ কান্নার শেষ নেই।পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিদের না পেয়ে এসব পরিবারে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ। স্বজনদের হারিয়ে অভাব অনাটনের মধ্যেদিয়ে কাটছে তাদের।

চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে সূত্রে জানা গেছে, জসিম মাঝির ট্রলার নিয়ে সিডরের কয়েকদিন আগে মাছ শিকারের গিয়েছিলেন ভোলার চন্দ্রপ্রসাদ গ্রামের ৯ জেলে। মাছ শিকার শেষে কারো নতুন ঘর তৈরী, কারো বিয়ে বা সন্তনের বইখাতা আর স্কুলে ভর্তি করানোর কথা ছিলো। কিন্তু সিডরের ঝড়ে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয়েছেন বজলু, রুবেল, জসিম, নুরু, সহিদুল, ইব্রাহিম, মামুন, জামাল আর রুবেল নামের ৯ জেলে।

তারা ফিরে না আশায় অসমাপ্ত কাজগুলোর কিছুই করা হয়নি তাদের। স্বজনকে না পেয়ে ৯ বছর ধরে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। এখনও তাদের মনে করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন তারা। কেউ কেউ আবার তাদের ফেরার অপেক্ষায় এখন পথ চেয়ে আছেন।

নিখোঁজ বজলু মালের স্ত্রী মনোয়ারা ৯ বছর ধরে স্বামীর অপেক্ষায় আছেন, তার দাবী স্বামী একদিন জীবিত ফিরে আসবেন। স্বামীর প্রতিক্ষায় আজো পথ চেয়ে আছেন তিনি।

মনোয়ারা বলেন, ৫ মেয়ে রেখে স্বামী মাছ শিকারে গিয়ে সিডরে ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয়েছেন। অন্যের বাড়ি কাজ করে একবেলা খাওয়ালেও দ্’ুবেলা না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আর ঋন নিয়ে দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখনও ৩ মেয়ে রয়েছে, তাদের বিয়ে দিবো কিভাবে। স্বামী থাকলে এমন দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো না।নিখোঁজ রুবেলের মা আমেনা খাতুন। তার বিশ্বাষ ছেলে ফিরে আসবে, তাই এখনও ছেলের জন্য অপেক্ষা। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, ছেলেকে বিয়ে দেয়ার জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছি, বিয়ে আয়োজন করা হয়েছিলো, কথা ছিলো মাছ শিকার করে বাড়িতে ফিরলেই আনন্দ-উৎসব করে বিয়ে দেবো, কিন্তু কিছুই হলো না, ছেলে ফিরে এলো না।

নিখোঁজ জেলে জসিমের ভাই নাছির বলেন, ট্রলার ডুবির পর থেকে বিভিন্ন স্থানে ভাইর সন্ধান করেছি, কিন্তু কোথাও তাকে খুজে পাইনি। ছোট্র ৩টি ছেলেকে নিয়ে অন্য কোথায় বিয়ে না বসেই তার স্ত্রী জেসমিন আজো স্বামীর প্রতিক্ষায় আছেন।একই গ্রামের খালেক মাঝির ছেলে নুরু উদ্দিনও ছিলেন ওই ট্রলারের জেলে। সিডরের পর থেকে সেও নিখোজ।

সন্ধান মেলেনি তার আজও।নুরু উদ্দিনের বোন মমতাজ বলেন, যেখানেই থাকুক না কেন ভাই ফিরে ফিরে আসবেই, তার লাশ পাওয়া যায়নি, তাই সে বেচে আছে।তিনি বলেন, স্বামীর অপেক্ষা করে নুরুর স্ত্রী রাবেয়া অন্যত্র বিয়ে করেছেন। কিন্তু রেখে গেছে দুই ছেলে। তাদের দেখা শোনা করার কেউ নেই, অসহায় ছেলেদের ভরন পোশনের কষ্টে দিন কাটছে তাদের।

আনিছ চৌকিদারের ছেলে সহিদুল। কথা ছিলো সাগরে মাছ শিকার করে বাড়িতে এসেই নতুন ঘর তৈরী করবেন।সহিদুলের স্ত্রী আকলিমা বলেন, ছোট্র শিশুকে রেখে মাছ শিকারে গিয়েছিলো, বলেছিলো বাড়িতে ফিরে এসেই নতুন করে ঘর করবেন, সন্তানকে বই কিনে দিবেন। কিন্তু এসবের কিছুই হলো না। স্বামীর অপেক্ষায় এখনও পথ চেয়ে আছি।নিখোঁজ ইব্রাহিমের নাজমা বলেন, ভাইকে বিয়ে করানেরা কথা ছিলো। কিন্তু ভাই ফিরে এলেনা, তার কথা মনে করে আজো কেদে যাচ্ছি। একইভাবে নিখোজ মামুনের স্বজন কুলসুমও কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন একই কথা। তারা জীবিত ফিরে আসবেন অবিরাম এমন অপেক্ষার যেন শেষ নেই তাদের।

স্বামীর অপক্ষো করে ইউনুস খার ছেলে জামাল খা স্ত্রী রোকসানা অন্যত্র বিয়ে করেছেন। অভাব প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই ভবিষ্যৎ পেটের টানে বিয়ে করছেন তিনি।নিখোঁজ স্বজনদের অভিযোগ, ডিসরের ঝড়ে নিখোঁজ হলেও সরকারের দপ্তর থেকে তাদের কোন সাহায্য করা হয়নি। তাদের খোঁজ খবরও নেয়নি কেউ।
এ ব্যপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, নদীতে ঝড়-দুর্যোগসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিখোঁজদের সহায়তা চালু হয়েছে দুই বছর আগে। কিন্তু চন্দ্র প্রসাদের জেলেরা ৯ বছর আগে নিখোঁজ হওয়ায় তালিকা থাকলেও তাদের কোন বরাদ্দ দেয়া হয়নি।



মন্তব্য চালু নেই