ঘরের খাবার খেয়েই ওজন কমান
কিছু খাবার ও মসলা ওজন কমানোর প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সাহায্য করে।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন মালয়েশিয়া প্রবাসী জনস্বাস্থ্য পুষ্টিবিদ শওকত আরা সাঈদা(লোপা)।
তিনি জানান, নানান কারণেই ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। এর মাঝে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা অন্যতম। থাইরয়েডের গ্রন্থির অকার্যকারিতা, পলিসিসটিক ওভারি সিনড্রোম (PCOS), স্টেরয়েড ট্রিটমেন্ট, ডায়াবেটিস, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিষণ্ণ থাকলে, বয়স বেড়ে গেলে, কোনো কারণে শরীরে পানি জমে গেলে, অলসতা ইত্যাদি।
ওজন বৃদ্ধির ফলে অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতাও শুরু হয়। বিশেষ করে যখন পেটের মেদ বৃদ্ধি।
তাই শরীরের ওজন যে কারণেই বৃদ্ধি পেয়ে থাকুক না কেনো সময় মতো সচেতন হলে ওজন কমানো সম্ভব।
প্রথমেই যে কয়েকটি দিকে নজর দিতে হবে তা হল— সঠিক খাবার নির্বাচন, ব্যায়াম এবং সঠিক জীবনযাপন ব্যবস্থা।
তবে ঘরের কিছু খাবার ও মসলা ওজন ও পেটের মেদ কমানোর প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে সাহায্য করে।
লেবু পানি
এই পানীয় যকৃতের বিষাক্ততা দূর করতে সাহায্য করে। কারণ বিষাক্ততায় ভরপুর যকৃত কার্যকরভাবে চর্বির বিপাক করতে পারে না। তাই লেবু পানি বিষাক্ততা দূর করার এনজাইমের পরিমাণকে চমৎকার ভাবে বাড়িয়ে দেয়। ফলে যকৃত কার্যকর ভাবে কাজ করতে পারে। এছাড়া এটি দেহের বিপাক ক্রিয়াকেও বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
এক গ্লাস কুসুম গরম পানিতে মধ্যম আকৃতির একটি লেবু চিপে রস বের করে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেয়ে নিন প্রতিদিন। এটি খাওয়ার পর ৩০ মিনিট কিছু খাবেন না।
তোকমা
এই তোকমা বীজে রয়েছে উদ্ভিদ উৎস থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ মাত্রার ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড। এছাড়াও এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও খাদ্য আঁশ যা অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেট ভরা থাকার অনুভূতি দেয়। প্রতিদিন চার থেকে আট টেবিল-চামচ (৩০ থেকে ৬০ গ্রাম) তোকমা বীজ খেলে ক্ষুধা কম লাগবে এবং অতিরিক্ত খাওয়া থেকে রক্ষা করবে।
তোকমা বীজ পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে বিভিন্ন স্মুদি, সালাদ বা দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া যায়। সকালের নাস্তার বিভিন্ন সিরিয়ালের সঙ্গে মিশিয়েও খেতে পারেন। আবার সুপ বা কোনো কিছুর ঝোল ঘন করার কাজও এটা দিয়ে করতে পারেন।
আদা চা
আমরা অনেকেই জানি আদা হজমের জন্য খুব ভালো। এছাড়া এটি হচ্ছে থার্মোজেনিক অর্থাৎ এটি দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে কার্যকর ভাবে দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করে।
পেটের মেদ নানা কারনে হয়ে থাকে। যেমন: অতিরিক্ত খাওয়া, বয়সের কারণের, প্রয়োজনীয় হরমোনের উৎপাদন কমে গেলে, ব্যায়াম না করলে ইত্যাদি। আদা এসব সমস্যা প্রতিটিই সমাধান করতে পারে। তাই বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে, হজম শক্তি বাড়াতে এবং কর্টিসল হরমোনের উৎপাদন কমাতে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই কাপ আদা চা খান।
চার কাপ পানি ফুটিয়ে তাতে এক,দুই ইঞ্চি আদা খোসা ছাড়িয়ে স্লাইস করে সেই পানিতে দিয়ে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট চুলায় রাখুন। তারপর চুলা থেকে নামিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা হলে তাতে এক টেবিল-চামচ লেবু ও এক টেবিল-চামচ খাঁটি মধু ভালো করে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে পান করুন।
ঝাল মরিচ/গোলমরিচ
সাধারণত ঝাল মরিচে থাকে ‘কাপাসাইচিন’ নামক উপাদান যার রয়েছে থার্মোজেনিক বা দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা। এটি দেহের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেহের অতিরিক্ত ক্যালরি পোড়ায়। দ্য আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশন’য়ে এটাও বলা হয়েছে যে, যখন নিয়মিতভাবে ঝাল খাবার খাওয়া হয় তখন তা পেটের মেদ কমাতে সাহায্য করে। তাই মরিচ কাঁচা রান্না করে শুকণা মরিচ বা গুঁড়া করে খেতে পারেন।
লালমরিচে বেশি পরিমাণে ‘কাপাসাইচিন’ থাকে বলে ঝাল বেশি থাকে অন্যান্য মরিচ থেকে। গোলমরিচ সাধারণত এত ঝাল থাকে না কারণ এতে নির্দিষ্ট পরিমাণে ‘কাপাসাইচিন’ থাকে। যা চর্বি পুড়ানোর পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে এবং পেটের মেদ কমাতে সাহায্য করে। তাই ওজন কমাতে ঝালমরিচ ও গোলমরিচ প্রতিদিনের খাবারে যোগ করুন।
রসুন
আমরা হয়তো অনেকেই জানি, রসুন হৃদসংবহনতন্ত্রের তথা সিস্টলিক এবং ডায়াস্টলিক দুই ধরনের রক্তচাপের জন্যই ভালো। এটি ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে। রসুনের মাঝে ওজন কমানোর গুনাগুনও রয়েছে। প্রতি মিনিটে আমাদের দেহে কোষ নষ্ট হচ্ছে এবং সেখানে নতুন কোষ উৎপন্ন হচ্ছে। রসুন প্রি-ফ্যাট সেল তৈরিতে বাধা দেয় যা পরবর্তীতে ফ্যাট সেল এ রূপান্তরিত হয়। তাই প্রতিদিনের খাবারে রসুন যোগ করুন বিশেষ করে কাঁচারসুন পেটের মেদ কমাতে বেশ উপকারি।
এক কাপ পানিতে একটি লেবুর রস বের করে মিশিয়ে রাখুন। তারপর তিন কোয়া কাঁচারসুন চিবিয়ে খেয়ে লেবু পানিটা খেয়ে নিন। এভাবে খাওয়ার দুই সপ্তাহের মাঝেই পেটের মেদ লক্ষণীয়ভাবে কমতে শুরু করবে।
ভেষজ মসলার পানীয়
আমরা অনেক ধরনের সবজি ও মসলা ব্যবহার করি যাদের রয়েছে অনেক ঔষধি গুনাগুন। এগুলো দেহের বাড়তি চর্বির উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
যেমন: আদা, পুদিনা-পাতা, শসা, লেবু ইত্যাদি।
গবেষণায় পাওয়া যায়, যারা নিয়মিত আদা খান না তাদের তুলনায় যারা নিয়মিত খান তারা শতকরা ২০ভাগ বেশি ওজন কমাতে সক্ষম। শসাতে পানি এবং খাদ্যআঁশ থাকার কারণে এটি হচ্ছে পেটের মেদ কমানোর জন্য একটি উত্তম খাবার। ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ লেবু দেহে জমানো চর্বি পুড়িয়ে শক্তি অর্জন করে। এইসব উপাদানগুলো একসঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা পানীয় দেহের বিষাক্ততা দূর করে ওজন ও পেটের মেদ কমাতে সাহায্য করে।
দুই লিটার পানিতে একটি শসা টুকরা করা, এক টেবিল-চামচ কুড়ানো আদা, একটি লেবুর রস এবং ১০,১২টি পুদিনা-পাতা দিয়ে ফ্রিজে সারারাত রেখে দিন। পরদিন পানিটা ছেঁকে নিয়ে সারাদিন পান করুন।
দারুচিনি
দারুচিনি পেটের মেদসহ পুরো শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি হচ্ছে থার্মোজেনিক অর্থাৎ বিপাকক্রিয়া বৃদ্ধির মাধ্যমে এটি দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। আর এভাবেই এটি দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই বিপাকক্রিয়া বৃদ্ধি করার জন্য প্রতিদিনের খাবারে এক চা-চামচ দারুচিনির গুঁড়া যোগ করুন। দারুচিনি এমন একটি মসলা যা দিয়ে যে কোনো ধরনের খাবার তৈরি করা যায়।
প্রতিদিনের চা, কফি এমনকি দুধে এক চা-চামচ দারুচিনির গুঁড়া যোগ করে খেতে পারেন। এছাড়া কেক বা মাফিন বানাতেও যোগ করতে পারেন। সকালের নাস্তায় কোনো সিরিয়াল খেলে তাতে যোগ করতে পারেন বা যেকোনো সালাদ বা সসেও দিতে পারেন দারুচিনির গুঁড়া।
চর্বিহীন সাদা মাংস
চর্বিহীন মাংস সবচেয়ে বেশি ক্যালরি পোড়াতে সাহায্য করে। তাই প্রোটিনজাতীয় খাবার যেমন মুরগির মাংস খান। বিশেষ করে রাতের বেলা যখন দেহের বিপাকক্রিয়ার গতি ধীর থাকে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যেন সেটা তেলে ভাজা না হয়।
সবুজ চা
দ্য আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকাল নিউট্রিশন’য়ে বলা হয়েছে যারা প্রতিদিন চিনি ছাড়া চার কাপ সবুজ চা খান তারা শুধু এটা খেয়েই আট সপ্তাহের মাঝে ছয় পাউন্ডের বেশি ওজন কমাতে পারেন। কারণ সবুজ চাতে রয়েছে প্রাকৃতিক ফেনল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বিপাকক্রিয়াকে উন্নত করে।
এক কাপ পানি চুলায় দিয়ে তাতে সবুজ চা পাতা এক,দুই চা-চামচ বা ১টি ব্যাগ এবং চার,পাঁচটি পুদিনা-পাতা দিয়ে ফুটিয়ে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট ঢেকে রেখে দিন। তারপর ছেঁকে নিয়ে কিছুটা ঠাণ্ডা করে আধা বা এক চা-চামচ লেবুর রস আর চাইলে এক,দুই চা-চামচ খাঁটি মধু মিশিয়ে খান। ওজন কমাতে এভাবে দিনে তিন থেকে চারবার খাবেন বিশেষ করে খাবার পরে।
চুইংগাম
শুনতে অবাক লাগলেও চুইংগাম চিবানো মস্তিষ্ক এবং পাকস্থলীর জন্য একটি কৌশল। চুইংগামের গন্ধ আপনার ক্ষুধা দূর করতে সাহায্য করবে এবং অস্বাস্থ্যকর নাস্তা খাওয়ার ইচ্ছাকে প্রতিরোধ করবে। এছাড়া এটি শর্করা ও চর্বির ভাঙনে সাহায্যকারী স্যালিভা নামক এনজাইমের প্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে। তাই যখনি কিছু খেতে ইচ্ছে করবে একটি সুগার ফ্রি চুইংগাম মুখে দিয়ে চিবান।
আসলে ওজন কত সেটা নিয়ে চিন্তা না করে যদি যদি আজ থেকেই ওজন কমানোর ব্যাপারে আমরা মনস্থির করে সেটাকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা শুরু করি যেমন সুষম এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার গ্রহণ, ব্যায়াম এবং জীবনযাপনের ধারায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয় তাহলে ওজন কমতে বাধ্য।
লেখাটি পছন্দ হইলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।
নিয়মিত সুন্দর সুন্দর টিপস পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ এ অ্যাক্টিভ থাকুন।
মন্তব্য চালু নেই