খুলনার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ছেলে অবাক করা ফেসবুকের প্রেম!
মেয়েটা বাংলাদেশের খুলনার। ছেলেটা যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি শহরের।সাত সমুদ্র তেরো নদী দূরে থেকেও কীভাবে ভালোবাসা হয়ে গেল তাঁদের? লিখেছেন জুহি আশা নিজেই
চোখজোড়া জলে ভিজে এল। অনেক কষ্ট করেও কান্না থামাতে পারছি না। চাইছি না বাসার কেউ আমার কান্না দেখে ফেলুক। আম্মু আমার নাম ধরে ডাকতে লাগল, জুহি, জুহি! আমি এক দৌড়ে বাসার সামনে মাঠে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লাম। শীতের দুপুরের উষ্ণ রোদ আর ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস আমার চুল উড়িয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে শুরু করেছে। আমি বারবার মোবাইল ফোনটার দিকে তাকাচ্ছি। না, সে তো স্বপ্ন ছিল, আবার স্বপ্নই হয়ে গেল, আমার ভিনদেশি তারা। আমার ভালোবাসা।
বলছিলাম, ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বরের কথা। জ্যাকবের অপেক্ষায় ছিলাম আমি। তিন দিন পর আমাদের বিয়ে। অথচ জ্যাকবের খোঁজ নেই। ভাবছেন কে এই জ্যাকব? তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রই বা কী?
মায়াবী এক জোড়া চোখ
১৬ জুন ২০১২। সে রাতে বেশ ঘুম পাচ্ছিল আমার।
সকালে একটা জরুরি কাজ আছে। আর সকালে ওঠার কথা থাকলে আমার যতই ঘুম পাক না কেন, ঘুম হয় না। ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম জানালার ধারে, একটা ওয়েবসাইট চোখে পড়েছিল কিছুদিন আগে। জানতাম না এই ওয়েবসাইটটা জীবন বদলে দিতে যাচ্ছে আমার।
ওয়েবসাইটে একটা ছেলের ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল। কী সুন্দর মায়াবী এক জোড়া চোখ, যেন খুব পরিচিত। ছেলেটাকে দেখার পর থেকেই অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছিল, এমনটা কখনো লাগেনি কাউকে দেখে। অনেক আগ্রহ হলো তাকে জানতে। ছেলেটার প্রোফাইলে ক্লিক করলাম, তার নামটা যদিও আমার খুবই অপছন্দের, জ্যাকব বারগিন, ডাকনাম জ্যাক।
ছেলেটা মার্কিন, টেনেসি শহরের। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, অবিবাহিত। জ্যাকবের প্রোফাইলটা ভালো লেগে গেল প্রথম দেখাতেই। তাকে মেসেজ লিখলাম একটা। কিন্তু মনে হচ্ছিল নকল প্রোফাইল নয়তো? পরদিন সকালে বাইরে যাওয়ার পরেও কয়েকবার ই-মেইল চেক করলাম, কোনো উত্তর নেই। আজব! এই ছেলে আমাকে পাত্তা দেয় না?
রাতে রুমে ফিরে গোসল করতে গেলাম ল্যাপটপটা চালু রেখেই। ফিরে এসে কয়েকটা লাফ দিলাম। জ্যাকব আমার সঙ্গে সরাসরি স্কাইপেতে কথা বলতে চায়। ভিডিও চ্যাট। আমি তাকে লিখলাম, একটু অপেক্ষা করো। তাড়াতাড়ি চোখজোড়ায় কাজল লাগালাম, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপ গ্লস, চুলটা শুকিয়ে স্কাইপেতে ভিডিও চ্যাটে বসলাম। সে গিয়েছিল শেভ করতে। একটু পরেই দেখি, আমার স্কাইপে ভিডিও কলের রিং বাজছে।
আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। ওমা, এ তো সত্যি! একে যেন আমি আগে কোথায় দেখেছি। খুব চেনা মুখটা আমাকে দেখে সুন্দর একটা হাসি দিল। আমি শুধু তার চোখজোড়া দেখছিলাম, ছলছলে এক জোড়া চোখ, যার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, তাকিয়ে থাকলে দেখা যায় অনেক কিছু। টের পাইনি কখন রাত ফুরিয়ে ভোর শেষে সকালের রোদ পড়ল আমার গালে। টের পেলাম যখন সে আমাকে সম্বোধন করল ‘মিষ্টি রোদের মেয়ে’ বলে।
আমরা বিদায় নিলাম ওই দিনের মতন। এরপর কথা হতো প্রতি রাতেই। ভালো তো আগেই লেগেছিল, আরও ভালো লাগতে শুরু করল, সে যে আমাকে ভালো লাগার চেয়ে একটু বেশি পছন্দ করে তা বোঝার পর।
কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, সম্পর্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কী করছি আমি? কেন করছি? কেন শুধু শুধু তাকে দুর্বল করছি আমার প্রতি? একদিন, শুধু জানার জন্যই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে ভালোলাগে তোমার জানি, ভালোবাসো? ও বলল, ‘হুম, ভালোবাসি তোমায়’। শুনে কি আমার মাথাটা একটু চক্কর দিল? মনে হলো পৃথিবীটা উল্টো ঘুরছে? ভালো লাগছে, খুব বেশি ভালো লাগছে আমার। কিন্তু আমি জানতাম না এ ভালো লাগার পরিণতি কী হবে।
গায়েহলুদের দিনে জ্যাকব ও জুহিভিনদেশি তারা
মাস খানেক পর আম্মুকে জানালাম আমার ভিনদেশি তারার কথা। আম্মু বুঝল আমায়। আম্মু কথা বলল জ্যাকবের সঙ্গে, ওকে আম্মুর খুব ভালো লাগল, কিন্তু আব্বু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারল না।
আমারও সব এলোমেলো লাগল, কেন করছি কী করছি বুঝতে পারছিলাম না। প্রেম-ভালোবাসা আমার জন্য নয়, মাত্র এক-দুই মাস কথা বলেই কারও প্রতি এত দুর্বল হয়ে যাব বুঝিনি। অনেকেরই আমাদের ব্যাপারটা ভালো লাগল না। তারা বিষ ঢালতে চাইল জ্যাকবের মনে, কিন্তু ওর মন বিষাতে পারল না। আমি নিজেই চেয়েছিলাম সরে যেতে, কোনো মানুষ আমার সুখে অসুখী থাকুক তা চাইনি।
সব ভেঙে দিলাম নিজের হাতে।
ওকে ‘ব্লক’ করে দিলাম সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম থেকে। পুরোনো একটা সিম চালু করলাম, যার নম্বর ওর কাছে নেই। সব যোগাযোগের পথ বন্ধ, কিন্তু আমি ওকে খুব মিস করছিলাম।
তবু যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই তা নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। দ্বিতীয় দিনে ও আম্মুকে ফোন করেছিল, ও পাগল হয়ে যাচ্ছিল আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। তৃতীয় দিনে আমি ওর ‘ব্লক’ খুলে দিলাম। আমার নিজেরই আর ভালো লাগছিল না। আবার শুরু হলো আমাদের প্রেম।
পরদিন ও আমাকে প্রপোজ করল, ‘উইল ইউ ম্যারি মি প্রিন্সেস?’ আমি হ্যাঁ বললাম। ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার কথা হলো, কিন্তু সমস্যা ছিল আমার আব্বু। আব্বুর সঙ্গে জ্যাকবকে স্কাইপে কথা বলিয়ে দিলাম, ও আব্বুরও মন জয় করে নিল। ওর বাবা-মা আমার নানার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলল। সমস্যাটা ছিল আমার বয়স। তখনো আমি ১৮ হইনি।
কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ছি। আমাকে অপেক্ষা করতে হলো আরও পাঁচ মাস। সবার সম্মতিতে ওই বছরই বিয়ের দিন ধার্য হলো। ১২-১২-১২(২০১২) এর ‘ম্যাজিকাল’ দিনে। এদিকে আম্মু-নানি, আমি আমার বিয়ের কেনাকাটা শুরু করে দিলাম। বিয়ে হবে খুলনায়, বাঙালি কায়দায়।
ভালোবাসা তোমায় ছোঁব
৯ ডিসেম্বর বেলা তিনটা। আমি আমাদের বাসার সামনে সবুজ ঘাসের ওপর বসে আছি, কাঁদছি। দুই দিন ওরা পথে। ও তুরস্কতে এসে একটা মেসেজ দিয়েছিল এক দিন আগে। ভোরে ওদের পৌঁছানোর কথা ঢাকায়।
আমাকে ফোন করার কথা, এখন দুপুর, কোনো ফোন আসেনি। খোদা কেন আমাকে আবার স্বপ্ন দেখাল? যদি তা সত্যি না-ই হবে? আমার ভুল ভেঙে দিয়ে ওর এসএমএস এল। ঢাকা পৌঁছাতে ওদের সময় লেগেছিল। ওরা ঢাকার রিজেন্সি হোটেলে আছে। জ্যাকব ছাদে দাঁড়িয়ে ঢাকা শহর দেখছে, আর আমার হবু শাশুড়িমা ওর ছবি তুলে আমাকে ফেসবুকে পাঠিয়েছে।
পরদিন আমার আত্মীয়রা গেল একটা কালো মাইক্রোবাসে করে যশোর এয়ারপোর্টে। আমি যাইনি, সাজছিলাম। সেই শত প্রতীক্ষিত মানুষটার জন্য। আমার জন্য শত শত পথ পাড়ি দিয়ে যার এই দেশে আসা।
ওরা বাসায় পৌঁছাল দুপুরে। আমাদের দেখা হলো, ও তো ছবির থেকেও আরও সুন্দর, আরও হ্যান্ডসাম। আমাদের প্রথম দেখার দিন ও আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত দুটো ধরে বাংলায় বলল, ‘জুহি, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আমার রাজকুমারী।’
বিয়ের দিনগুলো কীভাবে যেন পেরিয়ে গেল। বিয়ের পর জ্যাকব চলেও গেল। আমি যেন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আজ আমাদের বিয়ের প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে। আমাদের প্রেম আগের চেয়ে আরও গভীর হয়েছে।
সেই আগের মেতাই আমরা ভিডিও চ্যাট করি। সারাক্ষণই পাশে থাকি দুজন-দুজনার। অনেক ভালো আছি আমরা, শুধু একটাই কষ্ট আমাদের, আমরা সারাক্ষণই দুজন দুজনকে দেখতে পাই, কিন্তু চাইলেও ছুঁতে পারি না। এর মধ্যে ও অবশ্য বিয়ের প্রথম বছরেই আরেক বার বাংলাদেশ ঘুরে গেছে।
আমরা অনেকগুলো সুন্দর দিন কাটিয়েছি। একসঙ্গে বৃষ্টি দেখা, শপিংয়ে যাওয়া, একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, নানিবাড়িতে গিয়ে ওর প্রিয় দেশি ইলিশ খাওয়া। সেবার জ্যাকব চলে যাওয়ার আগের রাতে সারা রাত আমরা ছাদে বসে গান শুনেছি। চারটার দিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিলাম আমরা। কাচের দেয়ালের ওপারে ও বসে ছিল, আমরা কাচের ওপর দিয়েই দুজনের হাত ছুঁয়ে ছিলাম।
আমি ওর ঠোঁট দেখে বুঝতে পারছিলাম ও আমায় বলছে, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। জানি না ওকে পুরোপুরি নিজের করে কবে পাব। আমি এর মধ্যে ভর্তি হয়েছি টেনসির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। জ্যাকব কাজ করছে সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে। আমরা দুজনেই অপেক্ষায় আছি। আমার ভিসার জন্য অপেক্ষা। প্রিয় মানুষটাকে আরেক বার ছুঁয়ে দেখব বলে অপেক্ষা।
মন্তব্য চালু নেই