‘খালেদা ও তারেক নির্বাচনে অযোগ্য হতে পারে’
ওয়ান-ইলেভেন আমলে ও পরবর্তীতে জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা সচল হচ্ছে। এসব মামলায় সাজা হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার অযোগ্য হতে পারেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতি মামলা বাতিলে জারি করা রুলের নিষ্পত্তি ও রায় ঘোষণার জন্য ৫ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়েছে। এতে খালেদা জিয়াসহ ১৬ আসামিকে ১৩ এপ্রিল হাজির হতে বলেছেন বিচারিক আদালত। অন্যদিকে গ্যাটকোর দুটি ও নাইকোর একটি মামলা হাইকোর্টে কার্য তালিকায় এসেছে। এসব মামলার বিচার প্রক্রিয়াও দ্রুতগতিতে শেষ করার চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
জিয়া পরিবারের আইনজীবীদের আশঙ্কা, জিয়া চ্যারিটেবল ও অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার বিচার প্রক্রিয়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর বড় ধরনের সাজার খড়গ নেমে আসতে পারে। অন্যান্য মামলায়ও সরকার একই পথ অনুসরণ করতে পারে। আর এতেই আগামী নির্বাচনে বিএনপির শীর্ষ এ দুই নেতা অযোগ্য হবেন। জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেও অভিহিত করেন তারা।
সরকারসংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সাজার খড়গ নেমে এলে মেয়াদ ফুরানোর আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেওয়া হতে পারে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এ দুই নেতার বাইরে দলে অন্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যেতে পারেন বলেও মনে করেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় সরকার। এ কারণেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও ‘ধীরে চল’ পন্থা অনুসরণ করা হচ্ছে। তাই আদালতের নির্দেশের পরও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরোয়ানা এখনো থানায় পৌঁছেনি। সরকার চায়, আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা হোক। আর এজন্যই অপেক্ষায় তারা।
জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে নিত্যনতুন মামলা হচ্ছে জিয়া পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার দুই পুত্রবধূ ও নাতনিরাও বাদ যাচ্ছেন না মামলার খড়গ থেকে। সর্বশেষ ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ায় তার নামে দায়ের হওয়া সোনালী ব্যাংকের অর্থ ঋণের মামলাটিতে তার মা খালেদা জিয়া এবং স্ত্রী শর্মিলা রহমানসহ তার দুই নাবালিকা মেয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন করে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান ও তাদের একমাত্র সন্তান জায়মা রহমানের বিরুদ্ধেও মামলা দায়েরের আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবশ্য পুরনো এক মামলা রয়েছে ডা. জোবায়দা রহমানের বিরুদ্ধে। উচ্চ আদালত থেকে তিনি জামিন নিয়েছেন।
যে কোনো সময় ওই মামলাও সচল হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা গেছে, আগের পাঁচটিসহ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এখন ১৭টি মামলার আসামি। খুলনার ফুলতলা উপজেলার বাসে অগি্নসংযোগের ঘটনায় সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা করেছে স্থানীয় থানা পুলিশ। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও এ পর্যন্ত অন্তত ২৮টি মামলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকবন্ধু’ বলা মামলায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। এর সঙ্গে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর নামে দায়েরকৃত ডান্ডি ডায়িং ঋণের মামলাটির দায় চাপানো হয়েছে খালেদা জিয়াসহ তার স্ত্রী-সন্তানদের ওপর। মরহুম কোকোকে একটি মামলায় ছয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।
এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া প্রতিবেদককে বলেন, ‘নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই বেগম খালেদা জিয়াসহ তার পরিবারের সদস্যদের নামে মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এ বিচার বিভাগে এই অবিচার থাকবে না এবং জিয়া পরিবারের সদস্যসহ বিরোধী নেতা-কর্মীদের নামে এসব মিথ্যা মামলাও থাকবে না।’ দলের যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, “বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে বিএনপির এমন কোনো নেতা নেই যার নামে এ ‘অবৈধ’ সরকার মামলা দেয়নি। মামলার মধ্যেই যাদের বসবাস, তাদের আবার মামলার ভয় কী! তবে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব মিথ্যা মামলাও আর থাকবে না। এ কথা যারা এখন এসব মামলা দিচ্ছেন, তারাও ভালো করেই জানেন।
বিচারের মুখোমুখি : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি-প্রধান খালেদা জিয়া আজ বিচারের মুখোমুখি। ইতিমধ্যে আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছেন। প্রায় আড়াই মাস ধরে অবস্থান নেওয়া বেগম জিয়ার গুলশান কার্যালয়েও সার্চ ওয়ারেন্টের নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে সচল হচ্ছে খালেদার বিরুদ্ধে গ্যাটকো, বড়পুকুরিয়া ও নাইকো দুর্নীতি মামলাও।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্দসাতের অভিযোগ এনে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় এ মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ছয়জনকে আসামি করে ২০১০ সালের ৫ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলার অন্য আসামিরা হলেন সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান।
অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বছরের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। মামলাটির অভিযোগপত্র ১৫ জানুয়ারি আমলে নিয়েছেন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত। একই আদালতে অভিযোগ গঠনের পর মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য আছে।
গ্যাটকো মামলা : বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনকে আসামি করে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থানায় এ মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় চট্টগ্রাম ও কমলাপুরের কনটেইনার টার্মিনালে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মেসার্স গ্লোবাল অ্যাগ্রো ট্রেড কোম্পানি লিমিটেড বা গ্যাটকোকে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রের কমপক্ষে ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি করার অভিযোগ আনা হয়। ২০০৮ সালের ১৩ মে খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।
মামলাটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন খালেদা জিয়া। ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই আদালত মামলার কার্যক্রম দুই মাসের জন্য স্থগিত করেন এবং রুল জারি করেন। সময়ে সময়ে এ স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ ছাড়া এ মামলায় জরুরি ক্ষমতা অধ্যাদেশ যুক্ত করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৭ সালে আলাদা একটি রিট আবেদন করা হয়। হাইকোর্ট এ বিষয়ে রুল জারি করেন। ওই দুটি রুলের ওপর শুনানির জন্য দুদক আলাদা আবেদন করে, যা শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্য তালিকাভুক্ত রয়েছে।
নাইকো মামলা : কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি করার অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। এ মামলায় ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। এ মামলা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট এবং রুল জারি করেন। ওই রুলের ওপর শুনানির জন্য দুদক আবেদন করেছে, যা হাইকোর্টের কার্য তালিকায় রয়েছে।
তারেকও ২২ মামলার আসামি : এ পর্যন্ত অন্তত ২২ মামলার আসামি হয়ে লন্ডনে অবস্থান করছেন তারেক রহমান। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করা গেল কি না, সে বিষয়ে অগ্রগতির জন্য আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। গত বছরের ১৯ অক্টোবর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের অভিযোগে দায়ের করা হয় একটি মামলা।
এ মামলায় অভিযোগ করা হয়, তারেক রহমান তার লিখিত বইয়ে ‘জিয়াউর রহমান-ফার্স্ট প্রেসিডেন্ট অব বাংলাদেশ’ লিখে মিথ্যা, কাল্পনিক ও ভুল তথ্য উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তারেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরণ দ্রব্য আইনে করা দুটি মামলা। বর্তমান সরকারের আমলে এ দুটি মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমানকে আসামি করা হয়।
পরে তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়েই ২১ আগস্ট-সংক্রান্ত দুটি মামলার বিচারকাজ চলছে। সিআইডির দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে তারেক রহমান ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ডিউকসহ ৩০ জনকে আসামি করা হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেক রহমান আসামি রয়েছেন।
ড্যান্ডি ডায়িংয়ের ঋণ খেলাপের অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ২ অক্টোবর ৪৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম এ মামলা করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যশোর আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছে। ৯ নভেম্বর বাদী হয়ে এ মামলা করেন যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আফজাল হোসেন।
এ ছাড়া কাফরুল থানার পুলিশ বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাদী হয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কাফরুল থানায় আরেকটি মামলা করে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করে আয়কর ফাঁকির অভিযোগে আরও একটি মামলা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতারের পর তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মোট ১২টি মামলা হয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে এসব মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে। এগুলোর মধ্যে আটটি চাঁদাবাজির মামলা। ২০০৭ সালে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলাগুলো করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তারেক রহমান ও তার বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম বলেন, এসবই হলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে এসব ভিত্তিহীন মামলা একটিও থাকবে না।-বিডিপ্রতিদিন
মন্তব্য চালু নেই