খানসামায় যে কারণে বাড়ছে বাল্য বিবাহ !
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে : জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশে এখনো ৬৬ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার।তাই এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় । উপজেলার বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: সাজেবুর রহমান যোগদানের পর থেকে তিনি বাল্যবিবাহ রোধে কঠোর ভুমিকা নিয়েছেন। এরই মধ্যে তিনি নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে থানা পুলিশ ও স্থানীয় সমাজ কর্মীদের সাথে নিয়ে প্রায় ১০০ টি বাল্যবিবাহ রোধ করেছেন ও বাল্যবিবাহ দেওয়ার দায়ে প্রায় ৫০ জনকে জেল জরিমানা করছেন। তার এই কঠোর পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়েছে উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারন। ইউএনও সাজেবুর রহমানকে প্রায় প্রতি দিনই এই বাল্যবিবাহ রোধে গন সচেতন মূলক কর্মসূচি আয়োজন করতে দেখা যায়।তার এই কর্মতৎপরতায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কমে আসে খানসামায় বাল্যবিবাহের সংখ্যা । এরই মধ্যে গত ১৪ জানুয়ারী ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে দিনাজপুরের ১৩ টি উপজেলার মধ্যে খানসামা উপজেলাকে জেলার সর্বপ্রথম বাল্যবিবাহ মুক্ত উপজেলা ঘোষনা করেন গনপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রি খানসামার কৃতি সন্তান আবুল হাসান মাহমুদ আলী। কিন্তু তার পরেও প্রশাসনের কঠোর নজর দারির মধ্য দিয়েও মাঝে মাঝে এক দু’টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছেই। খানসামা উপজেলায় বাল্যবিবাহের কারন অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। এতে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য।
উপজেলায় বাল্যবিবাহের প্রধান কারন গুলো হচ্ছে দারিদ্রতা , স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া ও নিরাপত্তাহীনতা। অনুসন্ধানে আরও জানা যায় খানসামা উপজেলায় মেয়েদের পাশাপাশি অনেক ছেলেদেরও পরিপূর্ণ বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। দারিদ্রতার কারনে মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে কয়েকজন অভিবাবক জানান, মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেক যৌতুকের টাকা লাগে পাশাপাশি বিয়ের খরচ তো আছেই তাই এসব টাকা অভিবাবকরা বয়স্ক হয়ে গেলে সংগ্রহ করছে বেশ হিমশিম খেতে হয় তাই তারা খুব তারাতারিই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকেন বলে জানা গেছে।আবার কিছু কিছু নি¤œ বিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়ে প্রাথমিকের গন্ডি পার হওয়ার আগেই লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জড়িয়ে পরে শিশুশ্রমে। কয়েকবছর কাজ করেই পরিবারের হাল ধরতে হয় এসব হতভাগ্য কিশোর-কিশোরীদের।আর এর পরেই পরিবারের অন্য সদস্যদের পরামর্শক্রমে বাল্যবিবাহে জড়িয়ে পরে তারা। তাই ১ টি শিশুও যদি স্কুল থেকে ঝড়ে না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কার্যকারী পদক্ষেপ আশা করছে এলাকার সচেতন মহল। আরেকটি বিষয় গ্রাম এলাকার অভিবাবকদের বাল্যবিবাহ দিতে নাকি বাল্য করে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।বিষয়টি হচ্ছে তরুন তরুনীদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক। তরুন তরুনীর মধ্যে যখন এই বিতর্কিত সম্পর্কটি গড়ে উঠে, ঠিক তখনি যদি পরিবারের সদস্যরা সেটি জানতে পারছে তবে কিছু কিছু পরিবারের অভিবাবকরা নিজস্ব সম্মানের দিকে তাকিয়ে মেয়ে বাল্যবিবাহ দিয়ে দিচ্ছে বলে জানা যায়। সেক্ষেত্রে তরুন তরুনিদের মাঝে বিরাজমান প্রেম-ভালবাসা সম্পকির্ত মানসিক মনোভাব দূর করতে প্রয়োজনীয় সচেতনতা মূলক পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে।উপজেলায় বাল্যবিবাহের জন্য আরও দায়ি নকল জন্ম সনদ।ছেলে মেয়েদের জন্ম সনদ কার্ডে বয়স বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে স্থানীয় হাট-বাজার থেকে। বাজারের কিছু অসৎ কম্পিউটার ব্যবসায়ীরা মাত্র ২০ থেকে ৫০ টাকার বিনিময়ে বানিয়ে দিচ্ছে নকল জন্ম সনদ। এই নকল জন্ম সনদে বিশেষ এক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিব এর সীল ও সই নকল করে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে দেখে বোঝার ক্ষমতা থাকে না যে কোন টা আসল আর কোনটা নকল।আর এদিকে কাজি জন্ম সনদ অনলাইনে চেক না করার কারনে বুঝতে পারছে না এটা নকল জন্ম সনদ। তাই বাল্যবিবাহ ঠেকাতে অনলাইনের মাধ্যমে বয়স দেখে নেওয়া ও ওই সব অসৎ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন ছাড়া উপজেলায় বাল্যবিবাহ ঠেকানো সম্ভব হবে না বলে বিশিষ্ট জনেরা অভিমত দিয়েছে।অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাল্যবিবাহের বেশির ভাগ হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তার মধ্যে উপজেলার পাকেরহাট জেলে পাড়া অন্যতম।এ্ই বিশাল জেলে পাড়ায় অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে গত ৪ বছর আগেও যাদের বিয়ে হয়েছে তাদেরও এখন পযর্ন্ত ১৮ বছর পূর্ণ হয় নি। এখানকার শতকরা ৯০ ভাগ ছেলেদের বিয়ে হয় ২১ বছরের আগে ও ৯৮ ভাগ মেয়েদের বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। এই গ্রামটির আশেপাশের রাস্তা দিয়ে যেকেউ কোনো দিন যাতায়াত করলে বুঝতে পারবে এখানে বাল্যবিবাহের সংখ্যা কতটা বেশি।কিছু গ্রাম্য ঘটক অনেক সহজসরল অভিভাবককে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাদের সন্তানদের বাল্যবিবাহ দিচ্ছে বলে জানা যায়।খানসামায় বাল্যবিবাহ রোধে একাধিক এনজিও’র কাজ প্রশংসনীয়।কিন্তু তার পরেও তাদের কাজের কিছু দূর্বল দিক উঠে এসেছে অনুসন্ধানে । এনজিও গুলো কাজ করছে প্রধানত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক, তাই যারা সচেতন তারাই বেশি করে সচেতন হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু যেই সব শিক্ষার্থী স্কুল কলেজ থেকে ঝড়ে পড়েছে তাদেরকে কে সচেতন করবে এই প্রশ্ন রেখেছে এলাকা সচেতন মহল।তাই প্রতিটি গ্রামে বেশি বেশি করে অভিভাবকদের এনজিও গুলোকে সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে । ইফটিজিং এর প্রভাবেও মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন একাধিক অভিভাবক।উপজেলায় বাল্যবিবাহ বিরোধী অভিযান চলায় কিছু কিছু অভিভাবক তাদের মেয়েদেরকে বাইরের উপজেলার আত্মীয় স্বজনদের বাসায় নিয়ে গিয়ে গোপনে বিবাহের কাজ সম্পূর্ণ করছে বলে প্রমান মিলছে অনুসন্ধানে।তাই বাল্যবিবাহ রোধ করতে হলে অভিভাবকদের সচেতন করার কোন বিকল্প নেই বলে অভিমত বিশিষ্ট জনদের।
মন্তব্য চালু নেই