আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়

খণ্ডিত হচ্ছে গণতন্ত্র

সম্প্রতি ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অসহিষ্ণু বৈরিতার ফলে সংঘাত-সহিংসতার কবলে পড়ছে দেশ। সেবাধর্মী রাজনৈতিক লক্ষ্যের বদলে ‘লুটের ক্ষেত্র কায়েমই’ হয়ে উঠেছে দু’টি দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। তাই একদল আরেক দলকে যেকোনো মূল্যে ঘায়েল করে শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার নিরন্তর অপচেষ্টা দুদলের মধ্যেই অব্যাহত। এভাবেই গণতন্ত্র হয়ে পড়ছে কার্যত নির্বাসিত। দেশের এ অবস্থায় শুধু জনগণই নয়, উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। দেশটির প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার এ বিষয়ে শুক্রবার একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে বলা হয়েছে খণ্ডিত গণতন্ত্র।

‘গণতন্ত্রের উদ্বেগ’ আনন্দবাজারের ওই সম্পাদকীয়টি আওয়ার নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। এতে মূল সম্পাদকীয়র ভাষারীতি পরিবর্তন করে চলিত রূপ দেয়া হয়েছে।

গণতন্ত্রের উদ্বেগ
বাংলাদেশ অবশ্যই দরিদ্র দুনিয়ায় গণতন্ত্রের অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। কিন্তু সেই কারণেই, সে দেশে গণতন্ত্র যেভাবে খণ্ডিত হচ্ছে, তাতে উদ্বেগের বড় কারণ আছে। এক বছর আগের পার্লামেন্ট নির্বাচন বিরোধীরা বয়কট করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই তাতে জয়ী হয়। বিরোধী বিএনপি ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেশময় প্রতিবাদ-সমাবেশের ডাক দিলে তা বানচাল করতে হাসিনা ওয়াজেদের সরকার গোটা দেশে কার্যত জরুরি অবস্থার অনুরূপ নিরাপত্তার কড়াকড়ি কায়েম করে, বিরোধী দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ‘তারই নিরাপত্তা’র নামে কার্যত অন্তরীণ করা হয়। প্রতিবাদী আন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠেছে। শাসক ও বিরোধী দলের সমর্থকদের মধ্যে দেশব্যাপী সংঘর্ষ, তাতে মানুষ হতাহত হচ্ছে, দোকানপাট ভাঙচুর হচ্ছে, ঘরবাড়ি ভস্মীভূত, রাস্তায় লুটপাট, গুলিবোমা, ইটপাটকেল। বাংলাদেশ নতুন করে অশান্ত, অগ্নিগর্ভ।

এই পরিস্থিতি এড়ানো কি অসম্ভব ছিল? হাসিনা ওয়াজেদ ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সম্পর্কের শৈত্য ও বৈরিতা সত্ত্বেও বিরোধী পক্ষের আন্দোলনের পথ খোলা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ গণতন্ত্র মানে কেবল শাসকের অভিপ্রায় নয়, বিরোধীদেরও তাতে প্রতিবাদের পূর্ণাঙ্গ অধিকার স্বীকৃত। বিএনপি নেতৃত্ব যদি তার বয়কট করা নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দিয়া প্রতিবাদ জানাতে চায় এবং নতুন করে নিরপেক্ষ তদারকি সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামে, তবে তা নিষিদ্ধ করা ও নেতাদের গ্রেপ্তার করা কেমন ধরনের গণতন্ত্র?

বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামির যৌথ আন্দোলন সহজেই হিংসাত্মক হয়, তা সত্য। কিন্তু অতিরিক্ত দমন নীতি জনসাধারণের এক বৃহৎ অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাইরে আসার পথটিই রুদ্ধ করতে পারে, স্বাভাবিক নিষ্ক্রমণের পথ না পেয়ে এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ অন্তর্ঘাতেই বিস্ফোরণের পথ খুঁজবে।

উল্লেখ্য, খালেদা জিয়াও দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, তার দলের গণভিত্তি যথেষ্ট মজবুত। তাকে কার্যত অন্তরীণ রেখে তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করার উদ্যোগে কোথাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ক্রিয়া নাই তো?

পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের দল ‘কারচুপি করে ভোটে জিতে সরকার গড়েছে, অতএব সেই নির্বাচন বাতিল’ করার দাবিতে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের নেতা ইমরান খান যে প্রবল দেশব্যাপী প্রতিবাদ-আন্দোলন সংগঠিত করেন, তা পাক সরকারের পক্ষে এক বিপুল সঙ্কট ঘনিয়ে তুলেছিল। কিন্তু নওয়াজ শরিফ ইমরানসহ বিরোধী পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসে দেশে শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়েছেন।
বিরোধী পক্ষকে দমন করা নয়, দেশে সুশাসন চালানোই যে একটি নির্বাচিত সরকারের জনাদেশ, তা বুঝতে শরিফের অসুবিধা হয়নি। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি এক নয়, কিন্তু পাকিস্তানের সমস্যা কিছুমাত্র কম বলে মনে করারও কারণ নেই। গণতন্ত্রের স্বার্থেই নমনীয় হওয়া দরকার। আর শাসক পক্ষের দিক হতেই নমনীয়তা অধিক জরুরি। নয় তো রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা প্রবল, মৌলবাদীরা তার সুযোগ নিতে পারে। তার পরিণাম কেবল দেশের উদীয়মান ও সঙ্কটদীর্ণ অর্থনীতি নয়, দেশের শাসক দলের পক্ষেও শেষ বিচারে বিপজ্জনক।



মন্তব্য চালু নেই