ক্রিকেটার নিষিদ্ধ হলে আন্দোলন হয়, ধর্ষণে নয়!
ইউসুফ আলী শিমুল: কার যেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে পড়লাম, এদেশে কোনো ক্রিকেটার নিষিদ্ধ হলে যতটা আন্দোলন হয়, তনুদের ধর্ষণ হলেও ততটা আন্দোলন হয় না। আমাদের আবেগের বিপরীতে গেলেও কথাটা সত্য। তাসকিন আর সানিকে সন্দেহজনক বলিং অ্যাকশনের কারণে আইসিসি নিষিদ্ধ করার পর দেশজুড়ে আন্দোলন হবে স্বাভাবিক। আর একজন তনুর দেহ খুবলে খেয়ে কিছু ‘বীরপুরষ’ গলাকেটে ঝোপঝাড়ে ফেলে গেছে, এ নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে?
রোববার রাতে (২০ মার্চ) ময়নামতি সেনানিবাসের অলিপুর এলাকায় একটি কালভার্টের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তনুর লাশ। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের (সম্মান) শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনুকে (১৯) ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। তিনি এই কলেজেরই নাট্য সংগঠন ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের (ভিসিটি) সদস্য ছিলেন।
মঞ্চের ‘আঁধারি আলো’ই মানুষের মনে জ্বালায় মনুষত্বের আলো। সেই আলোয় নিজেকে আলোকিত করতেই চেয়েছিল তনু, সোহাগী জাহান তনু। নাট্যচর্চায় পরিশুদ্ধ মানুষ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছু নরপশুর মনুষত্বের অভাবে চলে যেতে হল দুনিয়া ছেড়েই। তার স্বপ্নের নীল আকাশে আক্রোশের নীল ছেয়ে গেল। সেই উড়ে বেড়ানো পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘগুলো ক্রমেই কালো থেকে কালো হয়ে হারিয়ে গেল নিমিষেই।
গণমাধ্যমে জেনেছি, তনু কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাসিন্দা ইয়ার হোসেনের মেয়ে। ইয়ার হোসেন ময়নামতি সেনানিবাস এলাকায় অলিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। সেই সুবাদে সোহাগীরা অনেক দিন ধরেই অলিপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করে আসছে। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সোহাগী মেজো। পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে সোহাগী পাড়াশোনার পাশিপাশি বাসার কাছে অলিপুর গ্রামেই এক বাসায় টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আসছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়, সুহাসিনী তনু। চোখেমুখে একরাশ স্বপ্ন। এমন একটা পবিত্র মুখ, দেখলেই মায়া লাগে। এমন একটা মেয়েকে নরপশুরা খুবলে খেয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় কালভার্টের পাশে ঝোপঝাড়ে ফেলে রেখেছে। নিজের আশ মেটানোর পর গলাকেটে হত্যা করে গেছে তাকে।
তবে হতাশার মাঝেও আশা জাগে। আজ কজন যুবক রাজধানীর শাহবাগে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংখ্যায় গুটিকয়েক হলেও আওয়াজ ছিল হৃদয়ের। তাই জোরটাও ছিল বেশ। হয়তো কাল থেকে সারাদেশেই প্রতিবাদ জোরালো হবে। নিজেদের দায়মুক্ত করতেই প্রতিবাদটা জানাতে হবে। শাহবাগে সাংবাদিক প্রান্ত পলাশ যেমনটা বলছিলেন, ধর্ষণ এর বিরুদ্ধে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে প্রতিবাদ জানাতে হবে এবং ধর্ষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে হবে।
নারীকে ‘বীরপুরুষরা’ সবসময়ই যৌন মিলনের সঙ্গীই ভেবেছে। কখনো পাশাপাশি চলা মানুষ মনে করেনি। তাই হয়তো কখনো জোর করেই আদায় করতে চেয়েছে তার ‘হক’। সমাজ বিজ্ঞানীরা ধর্ষণের সঠিক প্রভাবক আবিষ্কার করতে না পারলেও, সেডো-ম্যাসকিজমের (Sadomasochism) কথা সবাই কমবেশি স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ ভিকটিম কে শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত করে ইন্দ্রিয় সুখ লাভ। সব মানুষের মধ্যে কিছু পশুত্ব সুপ্ত থাকে এবং মানবিক গুণাবলীর অনুপস্থিতিতে ক্রোধ, হতাশা বা প্রতিশোধ পরায়ণতার কারণে সেই পশুত্বের প্রকাশ ঘটে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা, এ প্রবৃত্তি বাড়ছেতো বাড়ছেই। এর বড় কারণই কিন্তু এ প্রবণতাকে লাই দেয়া। বিচারে লঘু দণ্ড বা কোনো মতে রক্ষা পাবার আশা ধর্ষণের মুল প্রণোদনা। অন্তত আমাদের দেশের জন্য।
তনুর ঘটনা নিশ্চয়ই এদেশে প্রথম নয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ৪৩৬ নারী ধর্ষণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৯২ নারী। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পর্যালোচনা অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৮৪৬ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে ৬০ জনকে হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ২ জন। যেখানে ২০১৪ সালে ৭০৭ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে ৬৮ জনকে হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন ১৩ জন।
এগুলোতো পত্রপত্রিকায় এসেছে এমন ঘটনার তালিকা। যারা এসব সহ্য করে মুখ বুজে থাকেন তাদের হিসাব। এর বাইরের হিসাবটা আরো কত বড় হতে পারে তা অনুমান করা কঠিন। তবে আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লেগেছে এটা জেনে যে, ঘটনাটি ঘটেছে এমন এলাকায় যেখানে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনা সদস্যরা থাকেন। একটা ক্যান্টনম্যান্ট এলাকার ভেতরে এমন দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটানোর সাহস হয় কার?
শুনেছি হত্যার বিষয়ে সোহাগীর পরিবার যেন কোনো তথ্য দিতে না পারে, সেজন্য দিনভর তাদের নজরদারিতেও রাখা হয়েছিল। বন্ধ করে রাখা হয় তাদের মোবাইল ফোনও। এমনকি সোহাগীর সহপাঠীদেরও সেখানে যেতে দেয়া হয়নি। কেন?
সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘সেনানিবাস আইন, ২০১৬’-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়। এই আইনটি আরো যাচাই-বাছাই করে পরে উত্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোও হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ১৯২৪ সালের ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট দিয়ে এতদিন বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলো পরিচালিত হয়ে আসছিল। সেনানিবাসগুলো পরিচালনার জন্য আইনি কাঠামোর ভেতরে আনতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মন্ত্রিসভায় ‘সেনানিবাস আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করে। তবে প্রস্তাবে সেনাবাহিনীর কোনো মতামত নেয়া হয়নি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে আইনটি আবার ওই মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
ভাবছেন এই ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট আইনের সম্পর্ক কী? আছে। এ ঘটনাই প্রমাণ করে ক্যান্টনম্যান্টের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও কখন হয়তো থেকে যেতে পারে কোনো ‘নরপশু’। তাদের কারণে আমাদের সবচেয়ে গৌরবের একটা বাহিনী নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যেন না হয় সেজন্য সচেতন থাকতে হবে সেনাবাহিনীকেও। এগিয়ে আসতে হবে তনু হত্যার বিচারে।
ভুমিকায় আসি আরেকবার। তাসকিন কিংবা সানি নিষিদ্ধ হয়েছেন, সেটা যেমন আমাদের জাগিয়ে তুলেছে, সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফির কান্না যেন আমাদের আবেগে ভাসিয়েছে। তেমনি যে কোনো নৃশংসতা আমাদের কাঁপিয়ে তুলুক, সেটাইতো প্রত্যাশা। ভালো থাক তনুরা।
লেখক : সাংবাদিক
মন্তব্য চালু নেই