ক্যামেরায় ধরা পড়া প্রথম পরি
১৯১৭ সালের একদিন। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের কটিংলে গ্রাম। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, তবু এলসি আর ফ্রান্সিসের ফেরার নাম নেই। এলসি রাইট আর ফ্রান্সিস গ্রিফিথ দুই বোন। আপন বোন নয় অবশ্য। এলসির বয়স তখন ১৬ বছর, ফ্রান্সিসের ৯। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। এ সময়ই ফিরল দুবোন। ফেরার পর তাদের বকাঝকা দেওয়া শুরু হলো। কিন্তু সবটুকু বকা আর দেওয়া হলো না। ওদের দেরি হওয়ার কারণ শুনে সবাই থমকে গেল। ওরা নাকি পরির দেখা পেয়েছিল। সেই পরিদের দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে, ওরা টেরই পায়নি। প্রথমে তো ওদের কথা কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না। কিন্তু পরে যখন এলসি দেখাল, ওরা পরিদের ছবিও তুলে নিয়ে এসেছে, তখন আর কারো মুখে রাটিও নেই।
পরিদের ছবি
এলসি-ফ্রান্সিসরা থাকত ইয়র্কশায়ারের কটিংলে গ্রামে। কাছেই আছে একটা ভীষণ সুন্দর ঝরনা। নাম কটিংলে বেক। সেদিন এলসি-ফ্রান্সিসরা ওখানেই খেলতে গিয়েছিল। আর আসতে আসতে এত দেরি করে ফেলল, ওদের মা তো একদম রেগে আগুন। ওরা এসে যখন পরিদের গল্প বলল, প্রথমে তো ওদের মা বিশ্বাসই করতে চাইলেন না। আর মাকে বিশ্বাস করাতেই এলসি ছবিগুলো দাখিল করল—ফ্রান্সিসের চারপাশ দিয়ে কতগুলো ছোট ছোট পরি উড়ে বেড়াচ্ছে!
শুরু হলো তোলপাড়
এলসির মা আবার আধ্যাত্মিক বিষয়-আশয়ে বেশ বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন ভূত-প্রেত আর অশরীরী আত্মায়। কাজেই তিনি ছবিগুলো উপেক্ষা করতে পারলেন না। ওগুলো পাঠালেন আধ্যাত্মিক গুরু অ্যাডওয়ার্ড গার্ডনারের কাছে। তিনি আবার এগুলো পাঠালেন বিভিন্ন ফটোগ্রাফিক এক্সপার্টের কাছে। বিশেষজ্ঞরাও ধন্দে পড়ে গেলেন—ছবিগুলো তো আসলই মনে হচ্ছে। গার্ডনার আরেকজন বিশিষ্ট আধ্যাত্মবাদী ব্যক্তিকে ছবিগুলো পাঠালেন—স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। হ্যাঁ, শার্লক হোমসের স্রষ্টা কোনান ডয়েলই। তাঁর কাছেও ছবিগুলো বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হলো। কোনান ডয়েলের উদ্যোগেই ছবিগুলো একটা ম্যাগাজিনে প্রকাশ করা হলো। আর তাতেই শুরু হলো তোলপাড়।
অবশেষে স্বীকারোক্তি
এলসি-ফ্রান্সিসদের তোলা পরিদের ওই ছবিগুলো যে সত্যিকারের ছবি, তা অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন। আবার অনেকেই দাবি করেছিলেন, ওগুলো ভাঁওতা, স্রেফ ধাপ্পাবাজি। কিন্তু সেই সন্দেহে যতবারই ছোট্ট মেয়ে দুটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, ওরা একই কাহিনী বলেছে। বছরের পর বছর। ফলে কোনোভাবেই প্রমাণ করা যায়নি ছবিগুলো আসল নয়।
এর পর যত বছর গেছে, ঘটনাটা নিয়ে মানুষের আগ্রহও তত কমেছে। একসময় মানুষ এর কথা ভুলেও গেছে। পরে একে একে মারা গেছেন অ্যাডওয়ার্ড গার্ডনার আর আর্থার কোনান ডয়েলও। তারও অনেক পরে, গত শতকের আশির দশকে এসে, অবশেষে এলসি স্বীকার করেন, ওই ছবিগুলো আসল ছিল না। তাঁরা দুজন মিলে পরিদের ওই ছবিগুলো বানিয়েছিলেন। মজা করতেই এনমনটা করেছিলেন। কিন্তু সেই মজাটাই যে এমন বিশাল একটা ঘটনায় রূপ নেবে, তা একদমই বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পেরেছিলেন, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তবে ছবিগুলো যে আসল না, তা স্বীকার করার পরও ছবিগুলোর খ্যাতি কিন্তু মোটেও কমেনি। উল্টো দুই বোনের মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালে ছবিগুলো বিক্রি হয় চড়া দামে। সবগুলো মিলিয়ে মোট দাম ওঠে ২০ হাজার ইউরো!
‘আমি কৌতূহলোদ্দীপক ছবিগুলো দেখেছি … ওগুলো অসাধারণ।’
আর্থার কোনান ডয়েল
লেখক ও আধ্যাত্মবাদী ব্যক্তিত্ব
কটিংলের পরিদের ওই ছবিগুলো গত শতকের সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলোর অন্যতম। পৃথিবীতে যে সত্যিই পরি আছে, ছবিগুলো প্রায়ই তার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহূত হতো। পরে এলসি রাইট ছবিগুলোর গোমর ফাঁস করলে ছবিগুলোর সে মাহাত্ম্য ঘুচে যায়। তবে তাতে এলসি আর ফ্রান্সিসের কৃতিত্ব বরং আরো বাড়ে। স্রেফ একটা ক্যামেরা, কয়েক টুকরো কাগজ আর গল্প বলার দক্ষতা দিয়ে মানুষকে এমন একটা গল্প এত দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।
এলসি-ফ্রান্সিসের ওই পরিদের ছবির রহস্যের শুরুটা হয় ফ্রান্সিসের প্রিয় একটা বই থেকে। ওই ঘটনার কিছুদিন আগেই ফ্রান্সিসরা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডে আসে। আর সেদিন ফ্রান্সিসকে ওর মা ভীষণ বকেছিল। তখন বড় বোন এলসির মনে হলো, ছোট বোনের মন ভালো করার দায়িত্ব তো ওরই। আর সে জন্য তারা ফ্রান্সিসের ওই বইয়ের সাহায্য নিল। বইটির নাম ‘প্রিন্সেস ম্যারিস গিফট বুক’।
বইটিতে অনেক পরির ছবি ছিল। ওরা কতগুলো শক্ত কাগজে ওগুলোর মতো অনেক পরির ছবি আঁকল। তারপর সেগুলো সুন্দর করে কাটল। সেই পরিগুলোকে আবার চুলের ক্লিপ-কাঁটা দিয়ে ঝোপঝাড়ের বিভিন্ন ডালে ও পাতায় সুন্দর করে সাজিয়ে সাজিয়ে লাগাল। তারপর সেখানে তারা নানা পোজে অনেক ছবি তুলল।
বাকি কাজটুকু তো খুবই সোজা। ওরা ওদের তোলা ছবিগুলো নিয়ে চলে গেল এলসির বাবার ডার্করুমে। সেখানে গিয়ে যে ছবিগুলোর প্রিন্ট বের করল, সেগুলোই পুরো পৃথিবীকে ধন্দে রাখল পরের ৬০টি বছর!
৬০ বছর আগে এলসি রাইট ও তাঁর বোন ফ্রান্সিস গ্রিফিথ কিভাবে জাল ছবিগুলো বানিয়ে সবাইকে বোকা বানিয়েছিলেন, সেটাই আরেকবার করে দেখাচ্ছেন এলসি। তা করতেই কাগজ কেটে কেটে কতগুলো ছোট ছোট কাগজের পরি বানাচ্ছেন তিনি।-কালেরকন্ঠ
মন্তব্য চালু নেই