কোরবানীর ইতিহাস এবং বৈধতা

কোরবানী শব্দের অর্থ ত্যাগ। আল্লা কোরবানী করতে বলেছেন প্রিয় বস্তুটিকে। বাজার থেকে কিছু অর্থের বিনিময়ে একটি পশু কিনে এনে গলায় ছুরি চালাই তাতেই কি প্রিয় বস্তু ত্যাগ করা হয়? আমি তো কোরবানী করেই অপেক্ষায় থাকি কত তারাতাড়ি কোরবানীর গোস্ত রান্না করে মুখে দিবো মুস্তাহাব পালনের জন্য। সেটাও যে সোয়াবেরই একটা অংশ। এইবার যদি আমাদের মধ্যে একজন মানুষও চিন্তা করে আগামী বছর আর অবৈধ রোজগারের টাকা দিয়ে গরুর গলায় ছুরি চালাবো না। সামর্থবানদের জন্য কোরবানী ওয়াজিব আল্লার হুকুম। কিন্তু সে হুকুম পালনের জন্য আল্লা যে শর্তাবলী দিয়েছেন সেগুলির দিকে কে বা কারাই খেয়াল রাখি? বিত্তবানদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা হয় কে কত বড় গরু কোরবানী দিতে পারে! কেউ কি একবারও চিন্তা করেন কে কতটুকু হালাল টাকায় গরু কোরবানী দিতে পারেন? কোরবানী দেওয়ার জন্য যে নিয়ম-নীতি পালন করতে হয় কতটুকু তা করি? হাদীস শরীফে বলা আছে ঋণ থাকলে কোরবানী বৈধ নয়। কিন্তু সমাজের বড় বড় ঋণ খেলাপীরা একাধিক কোরবানীই করে। এমনকি অল্পসম্পদের অধিকারীরা যারা ভাগে কোরবানী করেন তাদের সাথে যদি এমন কেউ অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী থাকে তবে হালাল টাকা রোজগার কারীর কোরবানীও নষ্ট হবে। কোরবানী করার পর সুষ্ঠ বন্টনের দিকে কয়জন খেয়াল রাখি? এমন কি আমাদের কোরবানীর পর কোরবানীর নোংড়া আবর্জনায় যেন অন্যের সমস্যা না হয়; সেদিকে কয়জন খেয়াল রাখি? গোস্ত রেখে দেয় ফ্রীজের ভিতর জমা করে ।এমনও মানুষ পাওয়া যায় আগের বছরের কোরবানীর গোস্ত দিয়ে ঈদের দিন সকালে নাস্তা করে মানুষের সাথে গল্প করবে গত কোরবানীর গোস্ত দিয়ে নাস্তা করেছি। এটাই যেন কোরবানী করার গর্ভ। আল্লার দুনিয়ায় কত কিছুই না। আমি আশায় রয়েছি কবে যেন অলৌকিক ভাবে কোন কোরবানীর পশু উপরে ছবির কথাগুলি বলে উঠে একাধিক মানুষের মাঝে।
কোরবানীর শুরু ইতিহাস

যখন আদম ও হাওয়া পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়েছিল, তখন মা হাওয়া এর প্রতি গর্ভ থেকে জোড়া জোড়া (জময) অর্থাৎ একসাথে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ জময সন্তান জন্মগ্রহণ করত। কেবল শীস আ. ব্যতীত। কারণ, তিঁনি একা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। তখন ভাই-বোন ছাড়া আদম এর আর কোন সন্তান ছিল না। অথচ ভাই-বোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই আল্লা সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম এর শরীয়তে বিশেষভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্মগ্রহনকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারীনি কন্যা সহোদর বোন হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। সুতরাং সে সময় আদম একটি জোড়ার মেয়ের সাথে অন্য জোড়ার ছেলের বিয়ে দিতেন। ঘটনাক্রমে কাবীলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে ছিল পরমা সুন্দরী। তার নাম ছিল আকলিমা। কিন্তু হাবিলের সাথে যে সহোদরা জন্ম নিয়েছিল সে দেখতে অতটা সুন্দরী ছিল না। সে ছিল কুতসিত ও কদাকার। তার নাম ছিল লিওযা। বিবাহের সময় হলে শরিয়তের নিয়মানুযায়ী হাবীলের সহোদরা কুশ্রী বোন কাবীলের ভাগে পড়ল। ফলে আদম তৎকালীন শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবীলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে তার নির্দেশ মানতে বললেন। কিন্তু সে মানল না। এবার তিনি তাকে বকাঝকা করলেন। তবুও সে ঐ বকাঝকায় কান দিল না।

অবশেষে আদম তার এ দুই সন্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা উভয়ে আল্লার উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর, যার কুরবানী গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।” সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা (বর্জপাত) এসে সে কুরবানীকে ভষ্মীভূত করে ফেলত। আর যার কুরবানী কবূল হতো না তারটা পড়ে থকত। যাহোক, তাদের কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো- কাবীল ছিল চাষী। তাই তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভাল মালগুলো বের করে নিয়ে খারাপ মালগুলোর একটি আটি কুরবানীর জন্য পেশ করল। আর হাবীল ছিল পশুপালনকারী। তাই সে তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে সেরা একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করল। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবীলের কুরবানীটি ভষ্মীভুত করে দিল। {ফতহুল ক্বাদীরের বর্ণনায় পাওয়া যায়।} আর কাবীলের কুরবানী যথাস্থানেই পড়ে থাকল। অর্থাৎ হাবীলেরটি গৃহীত হলো আর কাবীলেরটি হলো না। কিন্তু কাবীল এ আসমানী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল না। এ অকৃতকার্যতায় কাবীলের দুঃখ ও ক্ষোভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল, এতে কাবীলের প্রতি তার সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। হাবীল বলেছিল, ‘তিনি মুত্তাক্বীর কর্মই গ্রহণ করেন। সুতরাং তুমি তাক্বওয়ার কর্মই গ্রহণ করো। তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন করলে তোমার কুরবানীও গৃহীত হতো। তুমি তা করোনি, তাই তোমার কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কোথায়? তবুও এক পর্যায়ে কাবীল হাবীল কে হত্যা করে ফেলল। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হাবীল ও কাবীল কর্তৃক সম্পাদিত কোরবানীর এ ঘটনা থেকেই মূলত কোরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে।

আমাদের মধ্যে অনেকেই জানিনা কোরবানির শুরুর আসল রহস্য। আমরা শুধু ইব্রাহিম আ. এর কোরবানিকেই অনুসরণ করে চলছি। কিন্তু ইব্রাহিম আ. এর পুত্র স্থলে দুম্বা কেন কোরবানী হলো এটাও বিশাল রহস্য। এই গুপ্ত রহস্যের ভেদ জানাও প্রতিটি মুসলমানেরই কর্তব্য।

কোরবানী (ত্যাগ) বলতে যে শুধু পশু কোরবানীর মধ্যেই সিমীত নয় উক্ত ঘটনাটি পর্যবেক্ষন করলেই বুঝা যায়। কোরবানীর পশুটির সাথে যদি মনের পশুটিকেও জবাই করা হয় তবে কতই না উত্তম হয়। আমি মনে করি আসল কোরবানী নিজের অন্তরের সাথে মিশে থাকা মিথ্যা, কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা যদি ত্যাগ করা যায় সেটাই হবে উত্তম ত্যাগ বা কোরবানী মানব সমাজের জন্য। এই মিথ্যা, কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা কোরবানীকারী (ত্যাগকারী) মানুষটির কাছে অন্য মানুষ নিরাপদ। সমাজ সংসার থেকে হিংসা বিদ্ধেষ শেষ হয়ে যাবে এই সব যদি কোরবানী করা যায়।



মন্তব্য চালু নেই